এই প্রশ্নটির উত্তর আমরা শেষ দিক থেকে শুরু করতে পারি। অর্থাৎ কোন ধর্মকর্মের মধ্য দিয়ে নাজাত পাওয়া সম্ভব কি না, তা নিয়েই আমরা আলোচনা শুরু করব। সংস্কৃত ধৃ ধাতু থেকে ধর্ম শব্দের উৎপত্তি। ধর্ম মানে ধারণ করা। মানুষ যে যে ধর্মীয় পরিবেশে জন্ম গ্রহণ করে, সাধাণরত সেই ধর্মকেই তার নিজের ধর্ম বলে বিশ্বাস করে। প্রত্যেক মা-বাবাই চান যেন সন্তান তাদের বিশ্বাসে বিশ্বাসী হয়, তাদের মতো ধর্মকর্ম পালন করে। ফলে কোন মানবশিশু যে ধর্মীয় পরিবেশে জন্মে, সেই ধর্মের নিয়মকানুনগুলো ধারণ করতে চেষ্টা করে। প্রত্যেক ধর্মই ভাল, প্রত্যেক ধর্মের নিয়মকানুনই মানুষকে সুন্দর ও সচ্চরিত্রবান হবার দিকে চালিত করে। মানুষ তাই সত্য ও সুন্দরকে ধারণ করার তাগিদে বেড়ে ওঠে এবং ভালমন্দ বিচার করে চলতে শেখে। এখন প্রশ্ন হলো, ধর্ম কি নাজাত পাবার জন্য?
ধর্মের উদ্দেশ্য কি, এ নিয়ে নানা মুনির নানা মত থাকতে পারে; কিন্তু বাস্তবতায় যা দেখা যায় তা হলো, শান্তির জন্যই ধর্ম বলা হলেও কোন ধর্মই মানুষকে দুনিয়াতে শান্তি দিতে পারেনি, পারছে না এবং ভবিষ্যতেও পারবে না। উক্তিটি আপাত দৃষ্টিতে কঠিন মনে হলেও হাজার হাজার বছরের ইতিহাস অনুযায়ী বাস্তবে তা-ই সত্য। কারণ পৃথিবীতে যত রকমের ছলচাতুরী, মিথ্যা, দুর্নীতি, হানাহানি, যুদ্ধ, মহাযুদ্ধ হয়েছে, তার প্রায় সবই ধর্ম নিয়ে ও ধর্মের কারণেই হয়েছে। ধর্মেধর্মে যেমন যুদ্ধ হয়েছে তেমনি একই ধর্মে বিভিন্ন গোত্রের মধ্যেও যুদ্ধ হয়েছে। ধর্মের নামে, ধর্মীয় বিচারের নামে, ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার নামে, ধর্মীয় মসজিদ-মন্দির-গির্জা-প্যাগোডা ইত্যাদির নামে, ধর্ম রক্ষার নামে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ সবসময় নিগৃহীত হয়েছে এবং আজো হচ্ছে। তাতে কি বোঝা যায়? বোঝা যায় ধর্ম ভালো হলেও গুনাহগার মানুষ ধর্ম ধারণ করতে পারে না। আসলে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে, মানুষ কোন ধর্মের মধ্য দিয়েই নাজাত পেতে পারে না।
নিচের এই মইটি দিয়ে ধর্ম পালনে মানুষের নির্মম ব্যর্থতার বিষটি বোঝাায়। প্রত্যেক ধর্মের মধ্যেই নিয়ম-কানুন আছে। মানুষ চেষ্টা করে সেই নিয়ম পালন করে অর্থাৎ নিয়মের সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠার জন্য। কেউ দুটি কেউ পাঁচটি আবার কেউ কেউ হয়তো আটটিও পালন করে কিন্তু সকল নিয়ম পালন করতে পারে না। ফলে কেউ ধর্মীয় নিয়ম কানুন পালন করে, কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করতে কিংবা ধার্মিকতা লাভ করতে পারে না। এই কারণে ইঞ্জিল শরিফে লেখা আছে, ‘ধার্মিক কেউ নেই, একজনও নেই।’ আসলে তা-ই। ১০০% ধার্মিক বলতে যা বুঝায়, তা কেউ অর্জন করতে পারে না। ফলে, নবি-পয়গাম্বরগণও আল্লাহর কাছে তাঁদের আপন আপন গুনাহর মাগফেরাত চেয়েছেন। হজরত দাউদ বলেন, “আমার সব অন্যায় তুমি ধুয়ে ফেল, আমার গুনাহ থেকে আমাকে পাকসাফ কর” (জবুর শরিফ ৫১:২)।
১০
৯
৮
৭
৬
৫
৪
৩
২
১
১ম ২য়
উপরিউক্ত মইটির দু’টি দিক দেখানো হয়েছে। নাম্বার দেওয়া যে মইটি আছে, তা হলো হজরত মুসার দেওয়া দশটি হুকুম বা শরিয়তের মই। সেখানে আছে দশটি ধাপ। এই ধাপগুলো অতিক্রম করতে কেউ কোন কালে পারেনি। তারপরও মানুষের রয়েছে আরো নানা ধর্মীয় নিয়ম কানুন। মই তৈরি করতে দুই পাশে দুটি মইদণ্ড বা লাঠি দিয়ে মাঝখানে ধাপগুলো দিতে হয়। যদি কোন মইতে দুই পাশের কোন এক পাশে লাঠি না থাকে, শুধু একপাশে থাকে এবং যথারীতি ধাপগুলো দেওয়া হয়, তবে কি ধাপগুলো অতিক্রম করা যাবে?
চিত্রে উল্লেখিত ২য় মই দিয়ে মানুষের দুর্দশার চিত্র দেখানো হয়েছে। ২য় মইয়ের একপাশে দেখা যাচ্ছে একটি লাঠি আছে কিন্তু অপর পাশে কোন লাঠি নেই। এরূপ মইয়ে কেউ যদি উঠতে যায় তবে প্রথম ধাপও কেউ উঠতে পারে না। এই মইয়ের প্রথম খাড়া লাঠি বা মই দণ্ডটি আল্লাহর দিক বোঝানো হয়েছে, দ্বিতীয় লাঠি মানুষের দিক। আর দ্বিতীয় লাঠির অনুপস্থিত ২য় মইটি মানুষের রুহানি অবস্থার কথা বোঝায়। রুহানি ভাবে মানুষ মৃত। অর্থাৎ আল্লাহর সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই। যার ফলে মানুষ যুগ যুগ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। এই মই বা সিঁড়ি একসময় উপযুক্ত বা দুইপাশে মইদণ্ডযুক্ত। আর তখন হজরত আদমের সাথে আল্লাহর সম্পর্ক ছিল জীবন্ত। কিন্তু অবাধ্যতার ফলে মই বা সিঁড়ির অপর লাঠি ভেঙে যায়। মানুষ চেষ্টা করেও সেই মইদণ্ড বা লাঠি আর তৈরি করতে পারে না। যে ধর্মেরই হোক না কেন মানুষ কেউ তার ধর্মীয় নিয়ম-কানুন সব পালন করতে পারে না। অতএব, ধর্মের মাধ্যমে নাজাত পাওয়া সম্ভব নয়।
ধর্ম বা শরিয়ত নাজাতের জন্য নয়, সমাজের শৃক্সক্ষলার জন্য: ধর্ম কি নাজাতের জন্য? কিতাবে আছে, শরিয়ত দেওয়া হয়েছে যেন মানুষ নিজেকে দেখতে পায়, তার অবাধ্যতার কথা তথা তার মৃত অবস্থার কথা যেন বুঝতে পারে। শরিয়ত বা ধর্মকর্ম হলো আয়নার মতো। আয়না যেমন মানুষের ত্রুটিবিচ্যুতি দেখায়, শরিয়তও মানুষের গুনাহ দেখায়। উদ্দেশ্য হলো গুনাহগার অবস্থার কথা জানতে ও বুঝতে পেরে যেন মানুষ নাজাত লাভের জন্য পদক্ষেপ নেয়।