মানুষ সামাজিক জীব। সমাজের আর দশজনের সাথে মিলেমিশে চলাই স্বাভাবিক। প্রত্যেক সমাজের মধ্যে কিছু লিখিত, কিছু অলিখিত নিয়ম কানুন আছে। মানুষ সেসব নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। জেনেশুনে কিংবা অভ্যস্ত হওয়ার ফলে, মনের অজান্তেই মানুষ সামাজিক নিয়মগুলো পালন করে। ঈসায়ীরাও যে যেখানে থাকুক না কেন সেই সমাজের রীতিনীতি তাদের মেনে চলা উচিত। মনে রাখতে হবে, সমাজে অনেক কর্মকাণ্ড আছে যা কিতাব সমর্থন করে না, তা পালন করতে গিয়ে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে নেমে আসে দুঃসহ যন্ত্রণা। সমাজ মানুষের মঙ্গলের জন্য, আবার একটি ছোট্ট ভুলের জন্য সেই সামাজিক নিয়মই মানুষের জীবনে চরম অশান্তি ডেকে আনে। বিয়ে একটি সামাজিক অনুষ্ঠান। কিন্তু বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা প্রধানত ধর্মগত, অতঃপর আইনগত।
ধর্মীয় বিশ্বাস: প্রত্যেক মানুষ তার নিজের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে চলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। এমনকি প্রগতিবাদী লোকেরাও সভা সমিতিতে প্রগতির কথা বললেও দেখা যায়, ধর্মীয় প্রশ্নে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনাকাঙ্খিত আচরণ প্রকাশ পায়। মুষ্টিমেয় নাস্তিক শ্রেণীর কথা বাদ দিলে, আদিকাল থেকেই মানুষ সমাজের কোন না কোন ধর্মীয় মূল্যবোধ নিয়েই জীবনযাপন করে। ধর্মীয় মূল্যবোধের কথা যখন বলা হয়, তখন বিভিন্ন ধর্মের কথা আসে। পৃথিবীতে এমন হাজারো প্রমাণ আছে যে, একই ধর্মের অনুসারী হয়েও কিছু ছোটখাটো বিষয়ে অমতের কারণে নিজেরা কলহ করে লক্ষলক্ষ লোক প্রাণ দিয়েছে। আমরা প্রোটেস্টান এবং রোমান ক্যাথলিকদের ধর্মযুদ্ধ, এ্যাংলিক্যান-প্রেসবিটারিয়ানদের দ্বন্দ্বের কথা জানি; জানি উমাইয়া-আব্বসীয় বংশের যুদ্ধের কথা, শিয়া-সুন্নি-ওহাবি-আহমদিয়া-ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় ইত্যাদি সম্প্রদায়ের বিয়োগান্ত পরিণতির কথা তো বলাই বাহুল্য। এ থেকে বোঝা যায় যে, মানুষ তার মনের গোপনে একটি নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাসকে লালন করে। কিন্তু বিয়ের ক্ষেত্রে দেখা যায়, পাত্র বা পাত্রী পছন্দ হলে, কোন কোন লোক কিছুদিনের জন্য ধর্মীয় মূল্যবোধকে জলাঞ্জলি দেয়। আর নিজের ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে সম্পর্কিত না হলেও পছন্দসই পাত্রপাত্রীকেই বিয়ে করে।
পরিণাম: আপাতদৃষ্টিতে ভাল মনে হলেও উপরিউক্ত বিয়ের পরিণাম ভাল হয় না। ঈসায়ীদের মধ্যে অনেক পরিবার সারাজীবন দুঃখকষ্টের শিকারে পরিণত হয়েছে এই অপরিণত সিদ্ধান্তের জন্য। সংসার ভেঙে ছারখার হয়েছে। ছেলেমেয়েরা কোন্ পরিচয়ে মানুষ হবে এই দ্বন্দ্বে পড়ে পুরো ধর্মীয় বিশ্বাসটাকেই বাদ দিতে দেখা গেছে। এমনও দেখা গেছে, স্বামী বড় নেতা, কোন এনজিওর পরিচালক, ইমাম, দক্ষ সমাজকর্মী, দোর্দণ্ড প্রতাপে সমাজে নেতৃত্ব দিচ্ছে, মিটিং মিছিল করছে; আর স্ত্রীও সমানে সমান। অর্থাৎ সামাজিক মর্যাদার দিক থেকে কেউ কারো চেয়ে কম নয়; অথচ ঘরে লাগাতার যুদ্ধ চলছে যা বাইরে থেকে দেখে বোঝার কোন সাধ্য নেই। দিনের পর দিন সেই নেতা-নেত্রী পারিবারিক জীবনে সম্পূর্ণ পরাজিত, বিধ্বস্ত এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে।
কিতাবে লেখা আছে, “তোমরা অসম যোঁয়ালে কাঁধ দিও না।” এই অসম যোঁয়াল ঈমানদার এবং অঈমানদারের বিয়ের ক্ষেত্রে বিবেচনা করা যায়। একজন ঈমানদার হজরত ঈসা মসীহের উপর ঈমান এনে কিতাব অনুযায়ী জীবন যাপন করে। এই অবস্থায় সে যখন ঈমান আনেনি এমন কোন লোককে আবেগতাড়িত হয়ে বিয়ে করে, তখন উভয়ের চালচলন, উভয়ের মধ্যে পার্থক্য এবং মতবিরোধের সৃষ্টি করে। এই কঠিন বাস্তবতায় উভয়েই তিলে তিলে নিঃশ্বেসিত হয়। বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই দেখা যায়, নিজেদের মধ্যে তো বটে, আত্মীয় স্বজনকে নিয়ে আরো বেশি অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। অতঃপর কোলে আসে সন্তান, ধীরে ধীরে বড় হয়। তখন স্বামী চায় তার মতো করে সন্তানকে মানুষ করতে, আবার স্ত্রী চায় তার মতো করে গড়ে তুলতে। শুধু তাই নয়, উভয়ের আত্মীয়স্বজনও নিজের নিজের ধর্মীয় কিংবা আদর্শগত ভাবধারায় তাদের আত্মীয়-সন্তানদের মানুষ করার জন্য উভয়কে অনুপ্রাণিত করে, প্রভাবিত করে, চাপ দেয়। তখন সমস্যা নিজেদের মধ্য থেকে সন্তানদের মধ্যেও বিস্তার লাভ করে। সন্তানরা মানসিক দ্বন্দ্বে হাবুডুবু খায়। জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিসহ।
ঈসায়ী হলেও ভাবতে হবে: বিয়ের ক্ষেত্রে শুধু ঈসায়ী বা খ্রিস্টান হলেই যে বিয়ে করতে হবে বা বিয়ে করার জন্য উপযুক্ত কিংবা বিয়ে করা যেতে পারে এমন চিন্তাধারাও ভুল। ঈসায়ী হলেও কোন কোন পাত্র-পাত্রীর ক্ষেত্রবিশেষ অসম যোঁয়াল হতে পারে। আমাদের দেশে অনেক ঈমানদার আছে যারা অজ্ঞানতা, কুসংস্কার, কুপমণ্ডুকতায় বাস করে। ঈসায়ী বা খ্রিস্টান নাম থাকলেও হয়তো দেখা যাবে কারো কারো বিশ্বাস আসলে কিতাবসম্মত নয়। অনেকে ঈসায়ী নামে পরিচয় দিলেও তারা হজরত ঈসাকে প্রভু বলে স্বীকার করে না, নিয়মিত কিতাব পাঠ করে না, মুনাজাত করে না, সাপ্তাহিক এবাদতে যোগ দেয় না বরং অন্যান্য ধর্মের নিয়ম মতোই জীবন যাপন করে। এই অবস্থায় তাদের কারো সাথে বিয়ে হলে, একজন প্রকৃত ঈমানদারের জীবনে নেমে আসতে পারে ভারসাম্যহীনতা ও দ্বান্দ্বিক জটিলতা।