সংক্ষিপ্ত উত্তর:
কারণ ঈসা মসীহই একমাত্র উদ্ধারকর্তা। তিনি এই কাজের উপযুক্ত অর্থাৎ নিষ্পাপ। এই কাজের জন্যই আল্লাহ তাঁকে দুনিয়াতে পাঠিয়েছিলেন।
কারণ ঈসা মসীহই একমাত্র উদ্ধারকর্তা। তিনি এই কাজের উপযুক্ত অর্থাৎ নিষ্পাপ। এই কাজের জন্যই আল্লাহ তাঁকে দুনিয়াতে পাঠিয়েছিলেন।
ঈসায়ীদের কবরে কিছুই জিজ্ঞাসা করা হবে না, কারণ তারা অনন্ত জীবনের নিশ্চয়তা পেয়েছে।
কবরে কী হবে, এনিয়ে মানুষের জিজ্ঞাসার অন্ত নেই। অনেকে ধারণা করেন, কবরে আজাব হয়। ইসলামি চিন্তা অনুযায়ী দুনিয়াতে বেঁচে থাকতে সঠিক ধর্মে ঈমান না আনলে এবং ভালোকাজ না করলে, শেষবিচারের আগেই কবরে বেশকিছু শাস্তি ভোগ করতে হয়। সেই শাস্তি খুবই ভয়াবহ। সেখানে মুনকির এবং নকির নামে দু’জন ফেরেশতা বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবেন; উদাহারণস্বরূপ সেই প্রশ্নগুলো হলো, “মান রাব্বুকা”, “মান দীনুকা”, “মান নবিওকা” অর্থাৎ তোমার প্রভু কে? তোমার ধর্ম কী এবং তোমার নবি কে ইত্যাদি। ইসলাম অনুযায়ী সেই প্রশ্নগুলোর যথার্থ উত্তর আরবি ভাষায় দিতে না পারলে, মানুষকে দুঃসহ শাস্তি ভোগ করতে হবে। এর ফলে, মৃত্যুর পর কবর আজাব নামে যে কঠিন শাস্তির কথা শোনা যায়, তাতে মানুষ খুবই ভয় পায়।
এই প্রশ্ন যে বা যারা করেন, তাদের মনে উপরিউক্ত বিশ্বাস আছে বলে, ঈসায়ীদের এই ধরনের প্রশ্ন করেন। এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর হলো, ঈসায়ীদের বিশ্বাস অনুসারে তারা কবরে কোন প্রশ্নের সম্মুখীন হবে না। কারণ তারা বিশ্বাস করে যে, যেহেতু হজরত ঈসা তাদের শাস্তি গ্রহণ করেছেন, সেহেতু মৃত্যুর পর শেষ বিচারের আগে কবরের মধ্যে কোন বিচার হবে না। এর কারণ হলো, কবর বিচারের জায়গা নয়। শেষবিচারের দিনই আল্লাহ সকলের বিচার করবেন। এই জন্য পাককিতাবের ইবরানি ৯:২৭ আয়াতে লেখা আছে, “আল্লাহ ঠিক করে রেখেছেন যে, প্রত্যেক মানুষ একবার মরবে এবং তারপরে তার বিচার হবে।” এই আয়াতে খুবই স্পষ্ট যে, মানুষের বিচার দুবার নয়, একবারই হবে এবং তা হবে রোজ হাশরে। আর যদি ঈমানদারদের মধ্যে কারো প্রশ্নের সম্মুখীন হতেই হয়, তবে তার উত্তরও যথার্থ আছে। ঈসায়ীদের উত্তরস্বরূপ পাককিতাবে লেখা আছে, “আল্লাহ মাত্র একজনই আছেন এবং আল্লাহ ও মানুষের মধ্যে মধ্যস্থও মাত্র একজন আছেন, সেই মধ্যস্থ হলেন মানুষ মসীহ ঈসা” (১ তীমথিয় ২:৫ আয়াত)। আর সেই মধ্যস্থ নিজের জীবন দিয়ে তাদের সকল উত্তর দিয়েছেন। সুতরাং তারা বিচার থেকে পার হয়ে গেছে।
ঈসায়ীদের বিশ্বাস হলো, মৃত্যুর পর স্বাভাবিক নিয়মেই মানুষের দেহ পচে গলে মাটিতে মিশে যায়। সকল মানুষের দেহের বেলাই তা হয় এবং মানুষের রুহ শেষবিচারের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
সকল ভাষাই বেহেস্তের ভাষা হবে।
ভাষার ক্ষেত্রে আল্লাহর কোন সীমাবদ্ধতা নেই।
ভাষা মানুষের আজন্ম অধিকার। জন্মের মধ্য দিয়ে মানুষ ভাষার সাথে পরিচিত হয়। কোন শিশু যে ভাষাভাষী মা-বাবার কোলে জন্মগ্রহণ করে, সে সেই ভাষা রপ্ত করে, সেই ভাষাতেই কথা বলতে ও যোগাযোগ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তবে আধুনিক মানুষ মাতৃভাষার গণ্ডি পেরিয়ে দুই তিনটি ভাষা শেখে। এমনকি অনেকে মাতৃভাষার মতোই বিভিন্ন ভাষাতে পারদর্শী হয়। ভাষা হলো মানুষের সীমাবদ্ধতার প্রতীক। মানুষ সব ভাষা বলতে পারে না কিন্তু আল্লাহ সব ভাষা বুঝতে পারেন। তাওরাত শরিফের পয়দায়েশ কিতাবের ১১ অধ্যায়ে দেখা যায়, মানুষ একসময় একটা ভাষাতেই কথা বলতো। তাওরাত লেখা হয়েছিল হিব্রু ভাষায়, যে ভাষায় হজরত মুসা কথা বলতেন। যেহেতু তখন পৃথিবীতে একটির বেশি ভাষা ছিল না, সেহেতু বলা যায় হজরত আদম ও বিবি হাওয়াও সেই হিব্রু ভাষাতেই কথা বলতেন। গুনাহের কারণে হজরত আদম ও বিবি হাওয়াকে আল্লাহ বেহেশত থেকে দুনিয়াতে পাঠিয়েছিলেন। গুনাহর কারণে যদি তাদের ভাষারও পরিবর্তন না হয়ে থাকে, তবে বলতে হয় হজরত আদম বেহেশতে হিব্রু ভাষায় কথা বলতেন। কিন্তু পয়দায়েশ ১১ অধ্যায়ে বিশেষ কারণে আল্লাহ মানুষের ভাষার মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করেছিলেন। ফলে মানুষ একে অপরের ভাষা বুঝতে না পেরে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল।
বেহেস্তে সবাই সব ভাষা বুঝবে: ভাষা ব্যবহারের আর একটি উদাহরণ আছে ইঞ্জিল শরিফের প্রেরিত কিতাবের ২ অধ্যায়ে। এখানে হজরত ঈসা মসীহের প্রতিজ্ঞা অনুসারে, পাকরুহ নেমে আসার পর সাহাবিরা তাঁর (পাকরুহের) দেওয়া শক্তিতে কথা বলতে শুরু করেছিলেন। লেখা আছে, “তাতে তাঁরা সবাই পাকরুহে পূর্ণ হলেন এবং সেই রুহ যাঁকে যেমন কথা বলবার শক্তি দিলেন সেই অনুসারে তাঁরা ভিন্ন ভিন্ন কথা বলতে লাগলেন। সেই সময় দুনিয়ার নানা দেশ থেকে আল্লাহভক্ত ইহুদি লোকেরা এসে, জেরুজালেমে বাস করছিল।” কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল, সেই আগত লোকদের ভাষা ভিন্ন ভিন্ন হলেও সবাই তাদের কথা বুঝতে পারছিল। তারা আশ্চর্য হয়ে বলছিল, “এই যে লোকেরা কথা বলছে, এরা কি সবাই গালীলের লোক নয়? যদি তা-ই হয়, তাহলে আমরা প্রত্যেকে কি করে নিজের নিজের মাতৃভাষা ওদের মুখে শুনছি? … আমরা সকলেই তো আমাদের নিজের নিজের ভাষায় আল্লাহর মহৎ কাজের কথা ওদের বলতে শুনছি।” এই ঘটনা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, আল্লাহ কিংবা তাঁর পাকরুহের কাছে ভাষার কোন সীমাবদ্ধতা নেই। অতএব, বেহেশতে যে যার মাতৃভাষাতেই সুন্দর করে কথা বলবে আর সবাই তা বুঝতে পারবে। শিশুর না বলা কথা ও হাসির ভাষা যেভাবে মা বোঝে, সেভাবে আল্লাহপাক আমাদের প্রিয় মাতৃভাষায় বলা কথা আরো বেশি করে বুঝবেন।
পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি লোক ঈসা নবির উম্মত তথা ঈসাতে বিশ্বাসী।
সংখ্যার দিক বিচার করে, কোন ধর্মকে কিংবা ধর্মের ভালমন্দকে বিচার করা যায় না। কেননা অনেক সময় দেখা যায় বেশিরভাগ লোকই কোন কোন খারাপ জিনিসকেই ভাল বলে স্বীকৃতি দেয়, তাই বলে সেই খারাপটি ভাল হয়ে যায় না। যেমন কিতাবে লেখা আছে- সবাই পাপ করেছে, তাই বলে কি পাপ ভাল জিনিস হবে। তবু অনেকে পৃথিবীর জনসংখ্যার ভিত্তিেেত কোন্ জাতির কত লোক আছে তা জানতে চায়। বিশেষত ঈসায়ীদের সংখ্যা কত তা জানতে চায়। পৃথিবীর জনসংখ্যার বিচারে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি লোক ঈসায়ী, দ্বিতীয় মুসলমান তৃতীয় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী, চতুর্থ নাস্তিক এবং পঞ্চম পৌত্তলিক। একথা বলা বাহুল্য যে, অনেকে ঈসায়ী পরিবারে জন্মের কারণে নিজেদের ঈসায়ী হিসাবে পরিচয় দেয়। এছাড়া অনেকে বংশগত এবং পরিবারগতভাবে ঈসায়ী কিন্তু তারা ঈসা মসীহের আদর্শ অনুসারে চলে না। আবার ঈসায়ীদের মধ্যে রয়েছে নানা মত ও মতবাদ। কোন কোন ঈসায়ী আছে তারা কিতাবের আয়াতকে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে ব্যাখ্যা করে এবং সেভাবে জীবন যাপন করতে চেষ্টা করে। অবশ্য এই অবস্থা প্রত্যেক ধর্মের কিংবা যেকোন মতবাদী দলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এতদসত্তেও পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি লোক ঈসা মসীহকে এবং তাঁর নির্দেশিত পথকেই সঠিক বলে গ্রাহ্য করে।
দেশ ও মহাদেশ হিসেবে বিবেচনা করলেও ইউরোপ মহাদেশের প্রায় সকল দেশ, উত্তর আমেরিকা মহাদেশের প্রায় সকল দেশ, দক্ষিণ আমেরিকার প্রায় সকল দেশ, অস্ট্রেলিয়ার প্রায় সকল দেশ খ্রিস্ট ধর্মের চর্চা করে। এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের মধ্যেই মুসলমানদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য দেখা যায়। তবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া ছাড়া এসব অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে মুসলামানদের পাশাপাশি হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টান ও ঈসায়ীদের সংখ্যাও দেখা যায়।
এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, অন্যান্য ধর্মের লোকদের মতো ঈসায়ী বিশ্বাস তথা খ্রিস্টধর্মেও কাজের ঈসায়ীর চেয়ে নামের ঈসায়ীর সংখ্যাই বেশি। তা হলেও তুলনামূলকভাবে ঈসায়ীর সংখ্যাই সারা পৃথিবীতে বেশি। ইঞ্জিল শরিফের প্রতিজ্ঞা অনুসারে, সারা পৃথিবী হজরত ঈসার নাম প্রচারিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি দুনিয়াতে দ্বিতীয়বার ফিরে আসবেন না।
আল্লাহর দয়ায় এবং মসীহে ঈমান আনার মধ্যদিয়েই তারা নাজাত পাবে।
আগের প্রশ্নের সাথে যুক্ত এই প্রশ্নের উত্তর হলো আল্লাহ পরম দয়ালু, তিনি মানুষকে ভালোবাসেন। তিনিই মানুষের বিষয়ে ন্যায়বিচার করবেন। তবে যতদূর জানা যায়, আগেকার লোকেরা হজরত ঈসার মধ্যদিয়েই নাজাত পাবে। আল্লাহ প্রথম থেকেই মসীহের কথা নবিদের মধ্যদিয়ে মানুষকে জানিয়েছিলেন। পয়দায়েশ কিতাব থেকে শুরু করে প্রায় সকল কিতাবেই মসীহের বিষয়ে ভবিষ্যতবাণী করা হয়েছিল। হজরত আদম থেকে শুরু করে, প্রায় সকল নবিই মসীহের সম্পর্কে জানতেন এবং তাঁকে বিশ্বাস করতেন। প্রায় সকল নবিই মানুষের কাছে হজরত ঈসা মসীহের কথা প্রচার করে গেছেন। হজরত মুসা, হজরত দাউদ, হজরত ইশাইয়া, হজরত ইয়ারমিয়া, হজরত ইহিস্কেল, হজরত ইয়াহিয়া প্রমুখ নবিগণ হজরত ঈসার আগমনের বিষয়ে দ্ব্যার্থহীনভাবে ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন। তারা যেমন তা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, তেমনি তারা চাইতেন যেন মানুষ তা বিশ্বাস করে। অনেকেই তাঁদের কথায় বিশ্বাস করতেন।
প্রকৃত ঈসায়ী ছাড়া কেউ বেহেস্তে যাবে না।
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে আরো একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। তা হলো, সকল ঈসায়ী বেহেশতে যাবে কি না? কিতাব অনুসারে উত্তর হলো, না। অনেকেই নিজেদের ঈসায়ী বলে দাবি করতে পারে কিন্তু সে যদি সত্যিকারের ঈসায়ী না হয়, তবে তার তো বেহেশতে যাবার প্রশ্নই উঠে না। ইঞ্জিল কিতাবে লেখা আছে, ‘শেষ দিনে আমাকে অনেকে হে প্রভু হে প্রভু বলে ডাকবে কিন্তু আমি তখন তাদের বলব, ‘আমি তোমাদের চিনি না’। সেই ঈসায়ীরাই কেবল বেহেশতে যাবে যারা তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে নাজাত দাতা হিসেবে হৃদয়ে গ্রহণ করবে এবং তাঁকে মুখে প্রভু ও মসীহ বলে স্বীকার করবে এবং তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী জীবন যাপন করবে। ইঞ্জিল শরিফ বলে, “নাজাত আর কারও কাছে পাওয়া যায় না, কারণ সারা দুনিয়াতে আর এমন কেউ নেই যার নামে আমরা নাজাত পেতে পারি” (প্রেরিত ৪:১২)। অতএব, ঈসায়ী পরিবারে জন্মের মধ্য দিয়ে অথবা জন্মের পর ভাল কাজের মধ্য দিয়ে কেউ ঈসায়ী হতে পারে না কিংবা কেউ বেহেশতে যাবার দাবি করতে পারে না। বেহেশতে যাবার অন্যতম শর্ত হলো, হজরত ঈসা মসীহের অনন্ত কোরবানির উপর ঈমান আনা।
না, শিশুরা নিষ্পাপ নয়। তবে নিরপরাধ বলা যায়।
শিশুদের বিষয়ে কমবেশ সবারই একটু পক্ষপাতিত্ব থাকে। এর কারণ হলো শিশুদের নিষ্কলুষ হাসি, সরল স্বভাব, সহজ চালচলন সবাইকেই আকর্ষণ করে। ফলে শিশুদের যে পাপী বলে, তাকেই অধিকতর পাপী বলে মনে হয়। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন জিনিস। কেননা বাস্তবে শিশুদের মধ্যেও স্বার্থপর চিন্তা এবং স্বেচ্ছাচারী অহংবোধ বিদ্যমান। এছাড়া অবাধ্যতা, একগুঁয়েমি এবং মা-বাবার ইচ্ছাবিরোধি কাজও তাদের নিষ্পাপ বলতে না পারার যথার্থ কারণ। তৌরাত শরিফে আল্লাহ বলেন, “মানুষের দরুন আর কখনও আমি মাটিকে বদদোয়া দেব না, কারণ ছোটবেলা থেকেই তো মানুষের মনের ঝোঁক খারপির দিকে” (পয়দায়েশ ৮:২১)। বাস্তবেই আমরা দেখতে পাই, শিশুদের যা নিষেধ করা হয় তাই তারা করে। তাদের পছন্দসই জিনিসের জন্য জেদ ধরে আর না পেলে রাগ করে। এতে বোঝা যায়, তারা এই স্বভাব জন্মসূত্রেই তাদের মা-বাবার কাছ থেকে লাভ করেছে। এই কারণে হজরত দাউদ বলেছেন, “হ্যাঁ, জন্ম থেকেই আমি অন্যায়ের মধ্যে আছি; গুনাহের অবস্থাতেই আমি মায়ের গর্ভে ছিলাম” (জবুর শরিফ ৫১:৫)। ইঞ্জিল শরিফে লেখা আছে, ধার্মিক কেউ নেই একজনও নেই, কারণ সবাই গুনাহ করেছে এবং আল্লাহর প্রশংসা পাবার অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
হ্যাঁ, ঈসায়ীরাও মুসলমান পরিচয় দিতে পারে।
সাধারণত মানুষ জন্মের মাধ্যমেই পরিচয় লাভ করে। যার মা-বাবা যে ধর্মে বিশ্বাসী সাধারণত জন্মগ্রহণকারী ব্যক্তি সেই ধর্মের লোক বলে পরিচয় দেয়। আবার ধর্ম পরিবর্তন করে কেউ কেউ নতুন পরিচয়ে পরিচিত হয়। আবার এমন অনেকে আছে, যারা ধর্মীয় পরিচয়ে পরিচিত হতে চায় না। তাদের কেউ কেউ মানবতাবাদী, কেউ কেউ সাম্যবাদী আবার কেউ কেউ কমিউনিস্ট হিসেবেও নিজেদের পরিচিত করতে চায়।
নিজের পরিচয় নিজেকেই ঠিক করতে হয়। কে কীভাবে পরিচিত হবে তা নিজের উপরই নির্ভর করে। মিথ্যা পরিচয় দেবার মধ্যে কোন বিশেষত্ব নেই বরং তাতে কাপুরুষতা প্রকাশ পায়। অনেকে প্রশ্নের সম্মুখী না হওয়ার কিংবা ঝামেলা এড়ানোর জন্য নিজ পরিচয় গোপন করে। জীবন রক্ষার তাগিদেও কেউ কেউ পরিচয় গোপন করে কিংবা ভিন্ন পরিচয়ে পরিচিত হয়। যেমন আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিাস্তানি হানাদারদের অত্যাচারে, প্রাণের ভয়ে কমল চন্দ্র হয়ে গিয়েছিল কামাল চান; আর হরভজন হয়েছিল হাসান চৌধুরী। এছাড়া সার্থসিদ্ধির জন্য যে কেউ ভিন্ন পরিচয় দেয় না তাও নয়। পাক-ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস থেকে জানা যায়, মুঘল আমলে, ব্রিটিশ আমলে, পাকিস্তান আমলে অনেকে আর্থিক ও রাজনৈতিক সুযোগ-সুবিধা লাভের জন্য নিজের আসল পরিচয় গোপন করে নতুন ও ভিন্ন পরিচয়ে পরিচিত হয়েছিল এবং কাক্সিক্ষত সুযোগ-সুবিধা লাভ করেছিল।
কোন মুসলমান ভাইকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় হজরত আদম, নুহ, ইবরাহিম, ইসহাক, ইয়াকুব, মুসা, দাউদ, ঈসা ইত্যাদী নবিগণ কোন্ ধর্মের লোক ছিলেন? তারা নির্দ্বিধায় উত্তর দেবেন, মুসলমান। এরপর যদি তাদের জিজ্ঞাসা করা হয় যে, সেইসব নবিদের উম্মতেরা কোন্ ধর্মের লোক ছিলেন, তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চিন্তা করে এক একজন এক একরকম উত্তর দেবেন। এর কারণ হলো, হজরত আদম, নুহ, ইব্রাহিম, ইসহাক ছাড়া বাস্তবে উপরিউক্ত নবিদের কেউ জাতিগতভাবে মুসলমান ছিলেন না। তারা প্রায় সকলেই ইহুদি বা ইসরাইল ছিলেন। আল্লাহপাক হজরত ইয়াকুবকে তাঁর নাম পরিবর্তন করে, ইসরাইল রেখেছিলেন। তারপর থেকেই ইসরাইল জাতির সূচনা হয়। তবে বনিইসরাইল বা ইহুদিরা হজরত ইবরাহিমকেই জাতির পিতা বলে দাবি করে। সেই দিক থেকে ইবরাহিমকেও ইসরাইল (মনোনীত) বলা যায়। এছাড়া আল্লাহ নিজেই হজরত ইবরাহিমকে ইসরাইল জাতির তথা তাঁর লোকদের পিতৃপুরুষ হবার জন্য মনোনীত করেছিলেন।
মুসলমান ভাইয়েরা দাবি করেন, ইবরাহিম তাদেরই একজন নবি, সেই দিক থেকে তিনি মুসলমান। তাত্ত্বিক দিক থেকেও তাঁকে মুসলমান বলা যায়, কেননা তিনিই যথার্থ উপায়ে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। বর্তমানে অনেক ঈসায়ী নিজেদের মুসলমান পরিচয় দিতে চায় এবং দেয়। এই পরিচয়ও তাত্ত্বিক দিক থেকে তো বটে ঈমানি সত্যের দিক থেকেও যথার্থ। ঈসায়ীরাও হজরত ঈসাকে তাদের একজন নবি হিসেবে বিশ্বাস করে ও মানে। হজরত ইবরাহিমকে যদি মুসলমান বলা যায়, তবে একজন ঈসায়ী অবশ্যই মুসলমান। কেননা ঈসায়ীরা হজরত ইবরাহিমকে কেবল নবি হিসেবে নয়, তাদের আদি পিতৃপুরুষ হিসাবেও বিশ্বাস করে। মূসলমান মানে আত্মসমর্পণকারী। হজরত ইবরাহিম বাধ্যতার মধ্য দিয়ে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। প্রথমত: তিনি আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে নিজের দেশ, আত্মীয়-স্বজন ও পৈতৃক ভিটেমাটি ছেড়ে, অজানা দেশের উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন। দ্বিতীয়ত: তিনি সন্তান পাবার জন্য আল্লাহর প্রতিজ্ঞার প্রতি নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন। তৃতীয়ত: নিজের একমাত্র প্রিয় ছেলের কোরবানির মধ্য দিয়ে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন।
হজরত ঈসা মসীহও আল্লাহর বাধ্য হয়েই নিজেকে সম্পূর্ণ নিচু করেছিলেন, গোলামের রূপ ধারণ করেছিলেন, মৃত্যু পর্যন্ত এমন কি ক্রুশে মহাযন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু পর্যন্ত নিজেকে আল্লাহর কাছে সমর্পণ করেছিলেন। ঈসায়ীদের জীবন মানে সমর্পিত জীবন, কোরবানির জীবন। বাহ্যিক ধর্মকর্ম ঈসায়ীদের মৌলিক বৈশিষ্ট্য নয়, বৈশিষ্ট্য হলো সমর্পণ। ঈসায়ীদের মূলকাজ হলো আল্লাহকে মহব্বত করা এবং মানুষকে মহব্বত করা। সেই মহব্বত কেমন? আল্লাহ যেমন মানুষকে মহব্বত করে মসীহকে কোরবানি হিসাবে সমর্পণ করেছিলেন। আবার মসীহ যেমন তাঁর উম্মতদের ভালোবেসে নিজেকে কোরবানি দিয়েছিলেন তেমনি সমর্পণ। ইঞ্জিল শরিফ বলে, “…তোমরা তোমাদের দেহকে জীবিত, পবিত্র ও আল্লাহর গ্রহণযোগ্য কোরবানি হিসেবে আল্লাহর হাতে তুলে দাও।” আমাদের বলা হয়েছে, কেউ এক গালে চড় দিলে, আমরা যেন আর এক গাল পেতে দিই, কেউ এক মাইল যেতে বললে, আমরা যেন দুই মাইল যাই, আর কেউ শত্রুতা করলে, আমরা যেন তাকে মহব্বত করি। তাই ঈসায়ীদের জীবন মানে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের জীবন। অতএব, এই দৃষ্টিকোন থেকে একজন ঈসায়ী নিজেকে মুসলমান দাবি করতে পারে, কোন সন্দেহ নেই।
মুসলমান শব্দের উৎপত্তি সালাম শব্দ থেকে। সালাম মানে শান্তি। হজরত ঈসা বলেন, আমি তোমাদের শান্তি দিতে এসেছি, আর আমারই শান্তি আমি তোমাদের জন্য রেখে যাচ্ছি। তিনি নিজে যেখানে যেতেন সালাম জানাতেন এবং সাহাবিদের শিক্ষা দিতেন যেন তারা কোথাও গেলে অন্যদের সালাম জানায়। এছাড়া মানুষের শান্তির জন্য তিনি তাঁর সারাটি জীবন ব্যয় করেছিলেন; অসুস্থকে সুস্থ হবার সুযোগ, বোবাকে কথা বলার সুযোগ, কালাকে বলার সুযোগ, খোঁড়াকে চলার সুযোগ, অন্ধকে দেখার সুযোগ এমনকি মৃতকে বাঁচার সুযোগ করে দিয়ে শান্তি স্থাপন করেছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা হলো, মানুষের অনন্ত শান্তির জন্যই তিনি তাঁর নিজের জীবন কোরবানি দিয়েছিলেন। আর ঈসায়ীরা সেই মসীহেরই উম্মত হিসেবে অবশ্যই মুসলমান পরিচয় দিতে পারে। কারণ তাদের কাছে প্রকৃত মুসলমানের সালাম বা শান্তি আছে।
কোরান শরিফের সুরা আল ইমরান ৩:৩২ আয়াতে হজরত ঈসার উম্মতদের আত্মসমর্পণকারী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। লেখা আছে, “ঈসা যখন তাদের অবিশ্বাস উপলব্ধি করল তখন সে বলল, আল্লাহর পথে কারা আমার সাহায্যকারী? হাওয়ারিগণ (ঈসা মসীহের আসল অনুসারী) বলল, ‘আমরাই আল্লাহর পথে সাহায্যকারী। আমরা আল্লাহর উপর ঈমান এনেছি। আমরা আত্মসমর্পণকারী, তুমি এর সাক্ষী।’ শুধু তা নয়, কোরান শরিফে হজরত ঈসার অনুসরণকারীদের সরাসরি মুসলিমও বলা হয়েছে। লেখা আছে, “আরও স্মরণ কর, আমি যখন হাওয়ারীদেরকে (ঈসা মসীহের আসল অনুসারী) এই আদেশ দিয়েছিলাম যে, তোমরা আমার প্রতি ও আমার রাসুলের প্রতি ঈমান আন, তারা বলেছিল, আমরা ঈমান আনলাম এবং তুমি সাক্ষি থাক যে, আমরা তো মুসলিম” (সুরা মায়িদা ৫:১১১)।