ত্রিত্ব বিষয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে, হজরত ঈসা মসীহের পুত্রত্ব নিয়ে ইতোমধ্যেই কিছু আলোচনা হয়েছে। এবার এই বিষয়টি ভিন্ন আঙ্গিকে তুলে ধরতে চাই। এই প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ অথবা না উভয়ই দেওয়া যায়। আপনি হয়তো ভাববেন এ হলো প্রশ্ন এড়িয়ে যাবার ফন্দি। আসলে তা নয়। আপনি দয়া করে, ধৈর্য রেখে শুনুন।
আল্লাহর কথা: প্রথমতঃ বলতে হয় যে, হ্যাঁ তিনি আল্লাহর পুত্র। এই স্বীকৃতি আল্লাহ নিজেই দিয়েছেন। হজরত ঈসা মসীহের জন্মের সময় ফেরেশতা বিবি মরিয়মকে বলেছিলেন, “পাকরুহ তোমার উপরে আসবেন এবং আল্লাহতা’লার কুদরতির ছায়া তোমার উপরে পড়বে। এই জন্য যে পবিত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করবেন তাঁকে ইব্নুল্লাহ বলা হবে” (ইউহোন্না ১:৩৫)। হজরত ঈসার তরিকাবন্দির সময় আল্লাহ স্বয়ং বলেছিলেন, ইনি আমার প্রিয় পুত্র এঁর উপর আমি সন্তুষ্ট। এই পুত্র ধারণাটি হজরত দাউদ তাঁর জবুর কিতাবেও উল্লেখ করেছিলেন। ইশাইয়া নবি মসীহের জন্মের হাজার বছর আগে এই পুত্রবিষয়ক ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন। তিনি ইশাইয়া কিতাবের ৯:৫ আয়াতে বলেন, “… একটি ছেলে আমাদের জন্য জন্মগ্রহণ করবেন, একটি পুত্র আমাদের দেওয়া হবে।”
হজরত ঈসার নিজের কথা: হজরত ঈসা নিজে এই পুত্র নামটি মেনে নিয়েছিলেন। তিনি সর্বদা আল্লাহকে পিতা বলে ডাকতেন। মুনাজাতের সময় প্রত্যেকবার তা উল্লেখ করতেন এবং তাঁর সাহাবিদেরকেও আল্লাহকে পিতা বলে ডাকতে উৎসাহিত করতেন। শিক্ষা দেবার সময় তিনি নিজের সম্পর্কে পুত্র কথাটি ব্যবহার করতেন। উদাহরণস্বরূপ, একবার তিনি এক ইহুদি নেতার সাথে কথা বলার সময় নিজের সম্পর্কে বলেন, “আল্লাহ মানুষকে এত মহব্বত করলেন যে, তাঁর একমাত্র পুত্রকে তিনি দান করলেন, যেন যে কেউ তাঁর উপর ঈমান আনে সে বিনষ্ট না হয় কিন্তু অনন্ত জীবন পায়” (ইউহোন্না ৩:১৬)। হজরত ঈসা আরো বলেন, “পিতা পুত্রকে মহব্বত করেন এবং তাঁর হাতে সমস্তই দিয়েছেন। যে কেউ পুত্রের উপর ঈমান আনে সে তখনই অনন্ত জীবন পায়” (ইউহোন্না ৩:৩৫,৩৬)। হজরত ঈসা মুনাজাত করে একবার বলেছিলেন, “পিতা, সময় এসেছে। তোমার পুত্রের মহিমা প্রকাশ কর যেন পুত্রও তোমার মহিমা প্রকাশ করতে পারেন” (ইউহোন্না ১৭:১)। এসব আয়াতে স্পষ্ট দেখা যায় যে, তিনি নিজেকে আল্লাহর পুত্র বলে দাবি করেছেন।
সাহাবিদের কথা: সাহাবিরা হজরত ঈসাকে পুত্র হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন। পাকরুহের পরিচালনায় সাহাবি পিতর বলেছিলেন, “আপনি মসীহ, জীবন্ত আল্লাহর পুত্র।” হজরত পৌল বলেন, “… তিনি (আল্লাহ) অন্ধকারের রাজ্য থেকে আমাদের উদ্ধার করে তাঁর প্রিয়পুত্রের রাজ্যে এনেছেন। এই পুত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আমরা মুক্ত হয়েছি অর্থাৎ আমরা গুনাহের মাফ পেয়েছি” (কলসীয় ১:১৩,১৪)। হজরত ইউহোন্না বলেন, “যাঁকে আমরা দেখেছি এবং যাঁর মুখের কথা আমরা শুনেছি তাঁর বিষয়েই তোমাদের জানাচ্ছি। আমরা তা জানাচ্ছি যেন তোমাদের ও আমাদের মধ্যে একটা যোগাযোগ-সম্বন্ধ গড়ে ওঠে। এই যোগাযোগ হলো পিতা ও তাঁর পুত্র ঈসা মসীহ এবং আমাদের মধ্যে” (১ ইউহোন্না ১:৩)।
ঔরসজাত পুত্র নয়: দ্বিতীয়তঃ বলতে হয় যে না, তিনি মানুষের ধারণাপ্রসূত শাব্দিক অর্থে আল্লাহর পুত্র ছিলেন না। অর্থাৎ আল্লাহর কালামে দৈহিক অর্থে পুত্র কথাটা ব্যবহার করা হয় নি। শাব্দিক অর্থে পুত্র হলো যদি কেউ বিয়ে করে এবং স্বামী-স্ত্রী হিসেবে স্বাভাবিক জীবন যাপন করে আর তার ফলে যে পুরুষ সন্তান জন্ম হয় তাকে পুত্র বলা হয়। কিন্তু হজরত ঈসার বেলায় তা প্রযোজ্য নয়। কারণ নবিদের কিতাব, ইঞ্জিল শরিফ এমন কি কোরান শরিফও এই সাক্ষ্য দেয় যে, হজরত ঈসা পাকরুহের দ্বারা জন্ম লাভ করেছেন। এক কথায় বলা যায় তাঁর জন্মের ব্যাপারে মা-কিংবা বাবা কারোরই কোন ভূমিকা ছিল না বরং আল্লাহর কুদরতিতেই তাঁর জন্ম হয়েছে। কিতাবের শিক্ষার আলোকে বোঝা যায়, এই পুত্র কোন শারীরিক কামনা বাসনার ঔরসজাত পুত্র নয়; এ হলো, হজরত ঈসার সাথে আল্লাহর এক নিবিড় ও গভীর সম্পর্কের প্রকাশ। যারা ঈসা মসীহের উপর ঈমান আনে, ইঞ্জিল শরিফে তাদেরও আল্লাহর সন্তান বলা হয়েছে। তবে কীভাবে সেই সন্তানত্ব লাভ করে তার ব্যাখ্যা ইঞ্জিল শরিফ পড়লেই জানা যায় এবং হজরত ঈসার পুত্রত্বের ব্যাখ্যাও তা থেকে লাভ করা যায়। ইঞ্জিল শরিফে লেখা আছে, “… যতজন তাঁর উপর ঈমান এনে তাঁকে গ্রহণ করল, তাদের প্রত্যেককে তিনি আল্লাহর সন্তান হবার অধিকার দিলেন। এই লোকদের জন্ম রক্ত থেকে হয়নি, শারীরিক কামনা বা পুরুষের বাসনা থেকেও হয় নি কিন্তু আল্লাহ থেকেই হয়েছে” (ইউহোন্না ১:১২, ১৩)। হজরত ঈসার জন্মও একইভাবে কোন কামনা বাসনার ফল নয়, এ হলো আল্লাহর মহাকুদরতির ফসল। অতএব, শাব্দিক অর্থে তিনি আল্লাহর পুত্র নন, বরং রুহানি অর্থে।
কিতাবি উদাহরণ: বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য আরো কিছু উদাহরণ দেয়া যাক। হরজত ঈসা শিক্ষা দেবার সময় নিজের সম্পর্কে বিভিন্ন দাবি করেছেন। তিনি বলেছেন, “আমি দুনিয়ার আলো, আমিই আঙুর লতা, আমিই জীবন খাদ্য, আমিই জীবন্ত পানি, আমিই জীবন্ত পাথর, আমি দরজা, আমি উত্তম মেষপালক।” একবার ভেবে দেখুন তো, যদি এই শব্দগুলোর প্রত্যেকটিকে শাব্দিক অর্থে ধরা হতো, তবে হজরত ঈসার অস্তিত্ব কোথায় থাকতো? আমরা ব্যবহারিক জীবনে সকল শব্দ দিয়ে শাব্দিক অর্থ বুঝাই না। উদাহরণস্বরূপ, আমরা বলি, আল্লাহ নিরাকার কিন্তু আমরাই মুনাজাত করে বলি, ‘হে আল্লাহ তুমি আমার দিকে চোখ তুলে দেখ, আমার মুনাজাত শোন, কিংবা আমার দিকে হাত বাড়াও।’ আমাদের এই কথাগুলো যদি শাব্দিক বিবেচনায় আনি, তাহলে বলতে হবে আল্লাহর দৃশ্যমান চোখ আছে, কান আছে আর হাতও আছে। আসলে কি তাই? না, তা সঠিক নয়। আল্লাহ হচ্ছেন রুহ, তিনি নিরাকার। আমরা আমাদের বোধের উপযুক্ত করে, আমাদের ভাষা দিয়ে, তাঁর উপর শব্দ আরোপ করি। তাই বলে যে, তিনি শুনতে পান না তা নয়। তিনি অসীম হলেও আমাদের সীমাবদ্ধতা জানেন, আর আমাদের মুনাজাত শোনেন এবং তার উত্তর দেন।
বিষয়ের গভীরে: অনেক বিষয় আছে যা যেভাবে বলা হয় তার বিপরীত অর্থেই বলা হয়। যেমন হজরত ঈসা একবার শিক্ষা দিতে গিয়ে বলেন, “আমি দুনিয়াতে শান্তি দিতে এসেছি এই কথা মনে করো না। আমি শান্তি দিতে আসিনি বরং মানুষকে মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে এসেছি; ছেলেকে বাবার বিরুদ্ধে, মেয়েকে মায়ের বিরুদ্ধে, স্ত্রীকে শাশুড়ির বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে এসেছি” (ইঞ্জিল শরিফ মথি ১০:৩৪,৩৫)। এই আয়াত শুনলে মনে হয় যেন হজরত ঈসা একজন হঠকারী ব্যক্তি, তিনি কারো মঙ্গল চান না। কিন্তু তিনি যদি অমঙ্গল চান তবে তিনি কেন বলেছেন, “তোমরা যারা ক্লান্ত ও বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছ, তোমরা সবাই আমারা কাছে এস; আমি তোমাদের বিশ্রাম দেব (ইঞ্জিল শরিফ মথি ১১:২৮)? অথবা কেন তিনি বলেছেন, “আমি তোমাদের জন্য শান্তি রেখে যাচ্ছি, আমারই শান্তি আমি তোমাদের দিচ্ছি; দুনিয়া যেভাবে দেয় আমি সেভাবে দিই না। তোমাদের মন যেন অস্থির না হয় এবং মনে ভয়ও না থাকে” (ইঞ্জিল শরিফ ইউহোন্না ১৫:২৭)? প্রথম আয়াতে তিনি না বোধক বলেছেন ঈমান আনার পার্থিব ফলাফল বোঝাবার জন্য। অর্থাৎ সত্যকে জানার ফলে, আমাদের আত্মীয় ও প্রতিবেশীরা যারা সত্যকে জানে না তারা আমাদের বিপক্ষে যায় আর এটাই স্বাভাবিক। কারণ সত্য আর মিথ্যা এক হতে পারে না, আঁধার এবং আলো একসাথে চলে না। কিন্তু আমরা যদি কথিত কথার গভীর অর্থ কিংবা প্রকৃত অর্থ বোঝার চেষ্টা না করি, তবে অনেক সময় চরম ভুল হতে পারে। ঠিক তেমনি হজরত ঈসাকে পুত্র বলার গভীর অর্থ লুকিয়ে আছে। আর সেই লুকিয়ে থাকা অর্থ হলো, পুত্র মানে প্রকাশক, যিনি আল্লাহকে হুবহু প্রকাশ করেছেন এবং সেই উদ্দেশ্যেই তিনি এই দুনিয়াতে এসেছেন। পাককালামে লেখা আছে, “আল্লাহকে কেউ কখনও দেখেনি। তাঁর সঙ্গে থাকা সেই একমাত্র পুত্র, যিনি নিজেই আল্লাহ, তিনিই তাঁকে প্রকাশ করেছেন” (ইউহোন্না ১:১৮)।
বাস্তব উদাহরণ: বাস্তব জীবনে আমরা অন্যদের বাবা কিংবা মা বলে ডাকি অহরহ। ভিক্ষুকেরা আমাদের বলে, “বাবা, একটা টাকা দিন।” আমরাও তদের বলি, “দিলাম তো বাবা, এবার যাও।” কিংবা মাগো একমুঠ ভিক্ষা দেন। এছাড়া বাবা মোহছেন আউলিয়া, বাবা শাহ্জালাল, বাবা মজু শাহ, বাবা ভাণ্ডারী, খাজা বাবা, দয়াল বাবা, পীর বাবা আরো কত না বাবা আমাদের আছে। আসলে কি আমরা তাদের শাব্দিক অর্থে বাবা বলি? কখনও না। মহাত্মা গান্ধী যদি শাব্দিক অর্থে ভারতীয়দের পিতা এবং শেখ মুজিব যদি শাব্দিক অর্থে আমাদের সকলের পিতা হতেন, তবে কত হাজার কোটি মায়ের দরকার হতো তা অংক কষে বলা যেত না।
অতএব, হজরত ঈসা আল্লাহর পুত্র তবে শাব্দিক অর্থের বিবেচনায় নয়; রুহানি অর্থে, যার মানে প্রকাশক। কেননা একমাত্র তিনিই আল্লাহকে সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করেছেন।