অনেকে এই প্রশ্ন করে যে, হজরত ঈসা তো ইসরাইল জাতির জন্য এসেছেন, তবে কেন আমরা তাঁকে সকল মানুষের নাজাতদাতা বলি? একদিক থেকে এটা যথার্থ যে হজরত ঈসা বনি ইসরাইল জাতির জন্য এসেছিলেন। আল্লাহ তাঁর লোকদের উদ্ধারের জন্যই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন এবং সেই প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী মসীহকে পাঠিয়েছেন। এর স্বপক্ষে যুক্তির জন্য যে আয়াতগুলো সাধারণত ব্যবহার করা হয় তা হলো এই: হজরত ঈসা মসীহের জন্মের হাজার বছর আগে, হজরত ইশাইয়া নবি বনি-ইসরাইলদের অবাধ্যতা ও মসীহকে অগ্রাহ্য করার বিষয়ে যে ভবিষ্যত বাণী করেছিলেন, তার উদ্ধৃতি ইঞ্জিল শরিফে দেওয়া হয়েছে। মসীহ যে তাদের জন্যই আসবেন ও পরবর্তিতে এসেছেন, তাই বোঝা যায়। কালামে লেখা আছে, “গরু তার মালিককে চেনে, গাধাও তার মালিকের যাবপাত্র চেনে; কিন্তু ইসরাইল তার মালিককে চেনে না, আমার বান্দারা আমাকে বোঝে না” (ইশাইয়া ১:৩)। হজরত ঈসার জন্মের আগে ফেরেশতা বিবি মরিয়মের কাছে এসে বলেছিলেন, “তুমি তাঁর নাম ঈসা রাখবে, কারণ তিনি তাঁর লোকদের তাদের গুনাহ থেকে নাজাত দেবেন” (মথি ১:২১)। হজরত ঈসা তাঁর কাজ শুরু করার পর, পরজাতি এক মহিলা উপকার চাইলে, হজরত ঈসা বলেছিলেন, ‘সন্তানদের খাবার নিয়ে কুকুরদের দেওয়া উচিত নয়।’ এতেও হজরত ঈসার বনি-ইসরাইলদের পক্ষপাতিত্ব করেছেন বলে মনে হয়।
অতপর হজরত ঈসা বেহেশতে চলে যাবার পর হজরত পিতর ইসরাইলদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, “আল্লাহ তাঁকেই বাদশাহ ও নাজাতদাতা হিসাবে নিজের ডানপাশে বসবার গৌরব দান করেছেন, যাতে তিনি বনি-ইসরাইলদের তওবা করবার সুযোগ দিয়ে, গুনাহের মাফ দান করতে পারেন” (প্রেরিত ৫:৩১)।
এগুলোই শেষ কথা নয়, আরো কথা আছে। বনি-ইসরাইল জাতির জন্য তাঁর আগমনের স্বীকৃতিতে যেমন আয়াত আছে, তার চেয়ে ঢের বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য মসীহের আগমনের বিষয়ে। শুধু হজরত ঈসা মসীহ নন, পৃথিবীতে যত মহাপুরুষ এসেছিলেন তারা কেউ কোন বিশেষ গোত্রের জন্য আসেন নি, এসেছিলেন সকল মানুষের জন্য। নবিরা সকল মানুষকেই হেদায়েত করতেন আর যারা নবির কথা শুনতো তারা রক্ষা পেত। তেমনি হজরত ঈসাও যে কেবল ইসরাইলদের জন্য আসেন নি বরং দুনিয়ার সকল লোকদের জন্য এসেছিলেন, তা নিচের দেয়া আয়াতগুলো থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়।
ইঞ্জিল শরিফে হজরত ঈসা নিজে বলেন, “আল্লাহ মানুষকে এত মহব্বত করলেন যে, তাঁর একমাত্র পুত্রকে দান করলেন যেন যে কেউ তাঁর উপর ঈমান আনে সে বিনষ্ট না হয় কিন্তু অনন্ত জীবন পায়” (ইউহোন্না ৩:১৬)। এই আয়াতে তিনি বনি-ইসলাইলদের কথা না বলে, মানুষকে বলেছেন। আর মানুষ বলতে পৃথিবীর সকল মানুষকে বোঝানো হয়েছে। কোন বিশেষ জাতি বা গোষ্ঠীর প্রশ্নই আসে না। আল্লাহ মানুষের দুঃখ দুর্দশা লাঘবের জন্যই মসীহকে এই দুনিয়াতে পাঠিয়েছিলেন। দুঃখার্ত মানুষের প্রতি সদয় হয়ে তাঁর আহ্বান, “তোমরা যারা ক্লান্ত ও বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছ, তোমরা সবাই আমার কাছে এস; আমি তোমাদের বিশ্রাম দেব” (মথি ১১:২৮)। হজরত ঈসা তাঁর বেহেশতে যাবার সময় শেষ আদেশ দিয়েছিলেন এভাবে, “বেহেশতের ও দুনিয়ার সমস্ত ক্ষমতা আমাকে দেওয়া হয়েছে। এই জন্য তোমরা গিয়ে সমস্ত জাতির লোকদের আমার উম্মত কর” (মথি ২৮:১৯)। হজরত ঈসা যদি কেবল ইসরাইল জাতির জন্য আসতেন তবে তিনি সমস্ত জাতি উল্লেখ করতেন না। এখানে পরিষ্কার করে বলা হয়েছে যেন সকল জাতির লোকদের কাছে যাওয়া হয়।
একদিন কোন এক পরিবারে শিক্ষা দেবার সময়, হজরত ঈসার মা ও ভাইয়েরা তাঁকে ডাকতে এসে ঘরের বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন। কেউ গিয়ে হজরত ঈসাকে একথা জানালো, হজরত ঈসা তাদের বলেছিলেন, ‘আমার মা ও ভাই তারাই যারা আমার উপর ঈমান আনে এবং আমার শিক্ষা কাজে লাগায়।’ আমরা জানি হজরত ঈসা নিজে ব্যক্তিগত জীবনে পিতামাতার বাধ্য ছিলেন। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে তিনি এই দুনিয়াতে এসেছিলেন তা ছিল গোটা মানব জাতির উদ্ধার। আর সেই মানব জাতির মধ্যে তাঁর মা ও ভাইয়েরাও পড়ে। তাই হজরত ঈসার মা নিজেও হজরত ঈসাকে প্রভু বলে ডাকতেন। হজরত ঈসা বিবি মরিয়মের গর্ভে জন্মেছিলেন সত্য কিন্তু তিনি পবিত্র আত্মা বা পাকরুহ থেকে জন্মেছিলেন।
বনি-ইসরাইল জাতির মধ্যে শামাউন নামে একজন মহান ও ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন। তিনি মসীহের অপেক্ষায় ছিলেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, মসীহকে না দেখা পর্যন্ত তিনি মারা যাবেন না। তাঁর ঈমানের জোরে তিনি মসীহকে দেখা পর্যন্ত বেঁচেছিলেন। তিনি তাঁর বাণীতে হজরত ঈসার আগমনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, “… মানুষকে নাজাত করবার জন্য সমস্ত লোকের চোখের সামনে তুমি যে ব্যবস্থা করেছ, আমি তা দেখতে পেয়েছি (লূক ২:৩০)। তিনি যদিও ইসরাইল জাতির লোক ছিলেন, তথাপি তিনি বলেন নি ইসরাইলকে, বলেছেন মানুষকে। অর্থাৎ আল্লাহর পরিকল্পনা কোন বিশেষ জাতির জন্য হতে পারে না, হলে তিনি পক্ষপাতদুষ্ট হবেন, সকলের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাঁর অনন্ত পরিকল্পনা সকল লোকের জন্যই করেছেন।
এক অর্থে বলা যায়, তিনি ইহুদিদের জন্যই এসেছিলেন, আর সেই ইহুদি হলো আসল ইহুদি। “বাইরের দিক থেকে যে ইহুদি সে আসল ইহুদি নয়, শরীরের বাইরে খৎনা করানো হলেই যে আসল খৎনা করা হলো তাও নয়। কিন্তু দিলে ইহুদি সে-ই আসল ইহুদি” (রোমীয় ২:২৮, ২৯)।
হজরত ইব্রাহিমের কাছে যে প্রতিজ্ঞা করা হয়েছিল তা ঈমানের মধ্যদিয়েই পূর্ণতা পেয়েছে। কারণ হজরত ইবরাহিম ঈমানের মাধ্যমেই ধার্মিক গণিত হয়েছিলেন। শরিয়তের হুকুম পালনের মধ্যদিয়ে হজরত ইবরাহিম ধার্মিক গণিত হননি কারণ তখন শরিয়ত আসেও নি। এর কারণ হলো, “শরিয়ত পালন করেই যদি কেউ দুনিয়ার অধিকার পেয়ে যায়, তবে তো ঈমান অকেজো হয়ে পড়ে আর আল্লাহর সেই ওয়াদারও কোন মূল্য থাকে না, কারণ শরিয়ত আল্লাহর গজবকে ডেকে আনে” (৪:১৪,১৫)। কিন্তু হজরত ঈসার জীবন দর্শন শরিয়ত নয়, তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্য হলো ঈমানের মাধ্যমে নাজাত। যেমন করে হজরত ইবরাহিম কেবল ঈমানের দ্বারাই ধার্মিক হয়েছিলেন। এতে বোঝা যায় যে, তিনি কেবল ইসরাইল জাতি তথা শরিয়ত পালনকারী লোকদের জন্য আসেননি, এসেছেন পৃথিবীর সকল মানুষের জন্য (রোমীয় ৪:২৩,২৪)।