সংক্ষিপ্ত উত্তর:
ত্রিত্ব হলো সর্বশক্তিমান একমাত্র আল্লাহর তিনটি চরিত্রের প্রকাশ।
ব্যাখ্যামূলক উত্তর:
ঈসায়ী ধর্মতত্ত্বের কয়েকটি কঠিন বিষয়ের মধ্যে ত্রিত্ব অন্যতম। যারা ঈসায়ী নন, তাদের জন্য যেমন বিষয়টি কঠিন তেমনি যারা ঈসায়ী ঈমানদার, তাদের জন্যও তা তেমনই কঠিন। অনেকের ধারণা হলো ত্রিত্ব মানে তিনজন আল্লাহ। অথচ কিতাবুল মোকাদ্দসের কোথাও তিনজন আল্লাহর অস্তিত্ব নেই; বরং একত্ববাদের শিক্ষাই সমধিক শক্তিশালী। তিন আল্লাহর অস্তিত্ব শুধু মানবজাতির জন্য ক্ষতিকরই নয় বরং বিশ্বব্রাহ্মাণ্ডের জন্য হুমকিস্বরূপ। স্বভাবতঃই প্রশ্ন জাগে, ত্রিত্ব কী? সংক্ষেপে ত্রিত্ব হলো এক এবং অদ্বিতীয় আল্লাহর তিনটি প্রকাশ। নিচে তাঁর এই তিনটি প্রকাশ দেখানো হলো:
বিশ্বপিতা: পাককিতাবে লেখা আছে, আল্লাহ আসমান ও জমিন সৃষ্টি করলেন। যখন কোন কিছুই সৃষ্টি হয়নি তখন আল্লাহ ছিলেন। আল্লাহ হলেন বিশ্বপিতা, কেননা সবকিছুর মূলেই রয়েছেন তিনি। এই পিতা আল্লাহকে দেখা যায় না। তিনি সৃষ্টির আগে কালাম হিসেবে বিরাজ করছিলেন। ইউহোন্না কিতাবে লেখা আছে, “প্রথমেই কালাম ছিলেন, কালাম আল্লাহর সঙ্গে ছিলেন এবং কালাম নিজেই আল্লাহ ছিলেন” (ইউহোন্না ১:১)। সৃষ্টির শুরুতে কোন কিছুরই অস্তিত্ব ছিল না, তখন শুধু একটি কালাম শোনা গিয়েছিল, “কুন্” অর্থাৎ হও। আর তাতেই পর্যায়ক্রমে আকাশ-মাটি-চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-নক্ষত্র-গাছপালা-পশু-পাখি সবই আল্লাহর কালামের সাহায্যে সৃষ্ট হলো। তাই আল্লাহ কেবল মানুষের পিতাই নন, তিনি সমস্ত সৃষ্টির পিতা, কারণ সকল সৃষ্টিই তাঁকে প্রকাশ করে। হজরত দাউদ বলেন, “হে মাবুদ, আমাদের মালিক, সারা দুনিয়ায় রয়েছে তোমার মহিমার প্রকাশ; বেহেশতে তোমার মহিমা তুমি স্থাপন করেছ” (জবুর শরিফ ৮:১)। কিন্তু আল্লাহর অস্তিত্ব কোথায়? ঈসায়ীরা বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ আছেন। তিনি নিরাকার, তাঁকে দেখা যায় না। এটি তাঁর অতুলনীয় গুণ। যা দেখা যায় তা সীমাবদ্ধ আর যা দেখা যায় না, তা অসীম। যদি তাঁকে দেখা যেত তবে তিনি সীমাবদ্ধ হয়ে যেতেন; তাঁকে দেখা যায় না বলেই তিনি অনন্ত অসীম হিসেবে বিরাজ করছেন।
বেহেস্তি পিতা: ঈসায়ীরা আল্লাহকে বেহেস্তি পিতা বলে ডাকে। পিতার সাথে যেমন সন্তানের অনবদ্য সম্পর্ক, ঈসায়ীরা আল্লাহর সাথে তাদের এই সম্পর্ক আছে বলে বিশ্বাস করে। হজরত ঈসাকে যখন তাঁর সাহাবিরা মুনাজাত করতে শিখিয়ে দিতে বলেছিলেন তখন তিনি আল্লাহর এই পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “তোমরা এভাবে মুনাজাত করো, ‘হে আমাদের বেহেস্তি পিতা।” এই পিতৃত্বের সাথে দুনিয়ার কোন সম্পর্ক নেই। এর সাথে সাধারণ পিতা-মাতা হবার যে শর্ত তারও কোন যোগসূত্র নেই। এটি একটি অপার্থিব সম্পর্ক যা কেবল বেহেস্তি আল্লাহর ক্ষেত্রেই মানায়, অন্যকোন ক্ষেত্রে নয়।
পুত্র: পুত্র মানে প্রকাশক। জাগতিক পিতার সন্তান চেহারায়, আচার-আচরণে, কথাবার্তায়, চালচলনে তার পিতাকে প্রকাশ করে। কিতাবে হজরত আদমকে আল্লাহর পুত্র বলা হয়েছে। আল্লাহ বনি-ইসারাইলকে বলেছেন, ইসরাইল আমার সন্তান। আল্লাহ হজরত ঈসাকে পাঠিয়েছিলেন যেন তিনি মানুষের কাছে আল্লাহকে সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করতে পারেন। হজরত ঈসা মসীহ বলেছেন, “যে আমাকে দেখেছে সে পিতাকে দেখেছে”। আল্লাহর কালামেই বলা হয়েছে, আল্লাহকে কেউ কখনও দেখেনি, তার কাছে থাকা পুত্রই তাঁকে প্রকাশ করেছেন (ইউহোন্না ১:১৮)। এই পুত্র শব্দও এখানে রুহানি অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে, আক্ষরিক অর্থে নয়। আক্ষরিক অর্থে পুত্র হবার জন্য প্রয়োজন ‘বাবা + মা = সন্তান’ এই ধারণার। এখানে তার প্রয়োজন নেই, কারণ এই যৌগিক ফলাফলের অর্থে হজরত ঈসাকে পুত্র বলা হয়নি, বলা হয়েছে পবিত্রতায়, আচরণে ও আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতায়।
পবিত্রতায়: আল্লাহ যেমন পবিত্র ঠিক তেমনি একমাত্র হজরত ঈসাও পবিত্র ছিলেন। তাঁর জন্মই হয়েছিল পবিত্রভাবে। হজরত ঈসার জন্মের আগে তাঁর মা বিবি মরিয়মের কাছে ফেরেশতা এসে বলেছিলেন, “পাকরুহ তোমার উপরে আসবেন এবং আল্লাহতা’লার কুদরতির ছায়া তোমার উপরে পড়বে। এই জন্য যে পবিত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করবে, তাকে ইব্নুল্লাহ বলা হবে” (ইউহোন্না ১:৩৫)। ‘পাকরুহ তোমার উপর আসবে’। তার মানে হলো এই পুত্রের জন্ম পাকরুহের শক্তি দিয়ে, অন্য কোনভাবে নয়। ফেরেশতা আরও বলেছিলেন যে, পবিত্র সন্তান জন্ম হবে’। মানুষ সাধারণত পাপস্বভাব নিয়েই জন্মায়। কিন্তু একমাত্র ব্যতিক্রম ঈসা মসীহ, তিনি পবিত্র হয়েই জন্মেছিলেন। আর এভাবে মসীহ আল্লাহর পবিত্র স্বভাবকে প্রকাশ করেছিলেন।
আচরণে: হজরত ঈসা তাঁর আচরণের মধ্যদিয়ে আল্লাহর সকল গুণাবলী প্রকাশ করেছেন। তিনি মহব্বতে পূর্ণ ছিলেন। প্রাত্যহিক জীবনে তিনি মানুষের দুঃখকষ্ট লাঘব করতেন। তিনি অসুস্থদের সুস্থ করতেন, অন্ধকে দেখার শক্তি দিতেন, খোঁড়াকে ভালো করতেন, অবশ রোগীকে চলার শক্তি দিতেন, কুষ্ট রোগীকে স্পর্শে ভালো করতেন, মন্দ আত্মায় পাওয়া লোকদের ভালো করতেন, এমন কি মৃতকেও জীবিত করতেন। মোট কথা তিনি ছিলেন আল্লাহরই মতো মহব্বতে এবং আরোগ্যকারী ক্ষমতায় পূর্ণ এক অসাধারণ মহাপুরুষ। আর সেই কারণে তিনি আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী জীবন যাপন করতেন এবং তাঁর আচরণ দ্বারা মানুষের প্রতি আল্লাহর আচরণ কী তা-ই প্রকাশ পেয়েছে।
সার্বভৌম ক্ষমতায়: হজরত ঈসা আল্লাহর মতো সার্বভৌম ক্ষমতা ব্যবহার করতেন। প্রথমত: প্রাকৃতিক শক্তিকে তিনি নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাঁর আদেশে ঝড় থেমে যেত, মাছ জালের মধ্যে চলে আসতো, ভূত চলে যেত, এমন কি মৃত লাশ উঠে দাঁড়াতো। তিনি মানুষের অন্তরের গোপন কথা জানতেন, নিজের মৃত্যু ও পুনরুত্থানের বিষয় জানতেন এবং ভবিষ্যতবাণী করতেন। তিনি পানির উপর দিয়ে হাঁটতেন, দরজা বন্ধ থাকলেও ঘরের মধ্যে প্রবেশ করতেন আবার মৃত্যুর পর- মৃত্যুকে জয় করে পুনরুত্থিত হয়ে, প্রাকৃতিক শক্তির উপর তাঁর সার্বভৌম ক্ষমতা প্রকাশ করেছেন।
আল্লাহর ইচ্ছায়: সবচেয়ে বড় কথা, এই পুত্র শব্দটি কোন মানুষের কাছ থেকে আসেনি কিংবা হজরত ঈসা নিজেও এই উপাধি নেননি বরং আল্লাহ স্বয়ং প্রকাশ করেছিলেন। জন্মের সময় ফেরেশতা বলেছিলেন, যে পবিত্র সন্তান জন্ম গ্রহণ করবেন তাঁকে ইবনুল্লাহ বলা হবে (ইউহোন্না ১:৩৫)। এ^ছাড়া দৈববাণীর দ্বারা কয়েকবার আল্লাহ বেহেস্ত থেকে ঈসা মসীহকে পুত্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাঁর নবুয়তের সময় আল্লাহ বেহেস্ত থেকে বলেছিলেন, “ইনিই আমার প্রিয় পুত্র, এঁর উপর আমি খুবই সন্তুষ্ট” (ইঞ্জিল শরিফ, মথি ৩:১৭)। এরপর হজরত ঈসা একবার তাঁর তিন সাহাবিকে নিয়ে পাহাড়ের উপর মুনাজাত করতে গিয়েছিলেন। আর সেখানে মুনাজাত করতে করতে তাঁর মুখ সূর্যের মতো উজ্জ্বল সাদা হয়ে গিয়েছিল, উপস্থিত সাহাবিরা মেঘের মধ্যে হজরত মুসা ও ইলিয়াসকে কথা বলতে দেখেছিলেন, আর তখন বাণী হয়েছিল, “ইনি আমার প্রিয় পুত্র, এঁর উপর আমি খুবই সন্তুষ্ট” (ইঞ্জিল শরিফ, মথি ১৭:৫)।
পাকরুহ: পয়দায়েশ প্রথম অধ্যায় দ্বিতীয় আয়াতে আছে, “আল্লাহর রুহ সেই পানির উপরে চলাফেরা করছিলেন।” এখানে আল্লাহর অস্তিত্বের প্রথম প্রকাশ পায়, আর সেই প্রকাশ হলো রুহ হিসেবে পানির উপর চলাফেরা। আগেকার নবিরা আল্লাহর পক্ষে কথা বলতেন, তবলিগ করতেন, ভবিষ্যতবাণী বলতেন। আর এসবকিছুই করতেন পাকরুহের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয়ে। আল্লাহর যত কিতাব এই পর্যন্ত নাজেল হয়েছে, তা পাকরুহের মধ্যদিয়েই হয়েছে। পাকরুহের অনুপ্রেরণা পেয়েই নবিরা কিতাব লিখেছেন। হজরত ঈসার নবুয়তের সময় বেহেস্ত থেকে পাকরুহ কবুতরের মতো হয়ে নেমে এসেছিলেন। পাকরুহ আল্লাহর অদৃশ্যতাকে প্রমাণ করেন এবং আল্লাহর সকল ক্ষমতা প্রকাশ করতে পারেন। হজরত ঈসা দুনিয়া থেকে বেহেস্তে চলে যাবার আগে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, তিনি তাঁর উম্মতদের জন্য পাকরুহকে পাঠিয়ে দেবেন। তিনি সত্যের রুহ, যিনি ঈমানদারদের অন্তরে থাকেন ও তাদের পরিচালনা করেন। আসল কথা হলো, মানুষ আল্লাহবিহীন থাকতে পারে না। সেই কারণে হজরত আদমকে আল্লাহবিহীন অবস্থায় মৃত বলা হয়েছে। নবিগণের মাধ্যমে হজরত ঈসা আসার প্রতিজ্ঞা করা হয়েছিল, যার মানে ইম্মানুয়েল অর্থাৎ আমাদের সাথে আল্লাহ। আর যতদিন হজরত ঈসা আসেননি ততদিন পাকরুহ এসে নবিদের পরিচালনা করেছেন এমনকি কিতাব লেখায় সাহায্য করেছেন। অতপর হজরত ঈসা এসেছেন ও মানুষের সাথে থেকেছেন এবং তিনি চলে যাবার পর পাকরুহকে পাঠিয়েছেন।