কোরআন ও কিতাবুল মোকাদ্দস: ইতিহাস ও বিজ্ঞানের আলোকে

৳ 0

ভূমিকা

 কেন একটা বইয়ের জবাব দেবার জন্য আরেকটি বই লেখা হলো?

যদিও দশ বছর আগে একটি বই প্রকাশিত হয়েছিল, তবু এত দিন পর কেন তা আবার পড়ার প্রয়োজন হলো?

ওই বইয়ে এমন কী ছিল, যার উত্তর লেখার জন্য একজন ডাক্তার ৩ বছর ওষুধপত্র থেকে দূরে ছিলেন?

ওই বইটা তিউনিশিয়া ও মরক্কোর প্রায় প্রতিটি বইয়ের দোকানে পাওয়া যায়

গোটা আমেরিকায় আলোড়ন তোলা সেই বইটি, যে-বইটি একজন মিশরীয় যুবকের হাতে দেখা যায়, যে যুবকটি তাঁর প্রেমিকাকে ওই বইটি পড়িয়ে প্রভাবিত করতে চায়।

ওটাই প্রথম বই যা লন্ডনের রিজেন্ট পার্কের মসজিদের বইয়ের তাকে কোরআন ও হাদিসের ঠিক নিচেই থাকে।

ওটাই প্রথম বই যা কোনো কোনো লোকের কাছে এতো মূল্যবান বলে মনে হয়েছে যে, ১৯৮৩ সাল থেকে এই বইটি মূল ফরাসী ভাষা ছাড়াও ইংরেজী, আরবী, ইন্দোনেশিয়ান, ফারশী, সার্বক্রোয়েশীয়, তুর্কী, উর্দূ, এবং গুজরাটি ভাষায় অনুদিত হয়েছে।

আমি তিউনিশীয় এক যুবকের কাছে প্রথম ওই বইটির কথা শুনি। তিনি আমাকে বলেছিলেন যে, একজন ফরাসী ডাক্তার ওই বইটি লিখেছেন। তিনি আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, “আপনি কি ডঃ মরিস বুকাইলির লেখা কিতাবুল মোকাদ্দস, কোরআন ও বিজ্ঞান বইটি পড়েছেন? তিনি ওই বইয়ে কিতাবুল মোকাদ্দস ও কোরআন সম্পর্কে অনেক কথাই বলেছেন। এমনকি তিনি এই কথাও বলেছেন যে, কোরআনে কোনো বৈজ্ঞানিক ভুল নেই।”

আমি যখন ডঃ বুকাইলির লেখা ওই বইটি পড়ছিলাম, আমি দেখেছিলাম যে, আসলেই তিনি কিতাবুল মোকাদ্দস ও কোরআন সম্পর্কে অনেক কথাই বলেছেন। তিনি বলেছেন,

“আএরপর আমি আরবী ভাষা শিখি এবং অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে কোরআনের আয়াতসমূহ পরীক্ষা করতে শুরু করি .. আমি এই স্থির সিদ্ধান্তে উপনিত হই যে, কোরআনে এমন একটাও বক্তব্য নেই যে বক্তব্যকে আধুনিক বৈজ্ঞানিক বিচারে খন্ডন করা যেতে পারে [1]

এর পাশাপাশি কিতাবুল মোকাদ্দসের কথার বলার সময়ে বলেছেন, তিনি কেবল একে ‘বৈপরিত্ত, ‘অসঙ্গত  “অবিশ্বাসযোগ্য কথা রয়েছে। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন যে, কিতাবুল মোকাদ্দস বিশেষজ্ঞরা তা এড়িয়ে গেছেন, আর যখন তারা ওইগুলো উল্লেখ করেছেন, তাঁরা তখন শব্দের মারপ্যাচে তা ধামাচাপা দেবার চেষ্টা করেছেন।[2]

ডঃ বুকাইলির বইটি পড়ে, স্পষ্টতই মুসলমানরা রোমাঞ্চিত হবেন, কারণ, যদি তা সত্য হয়, তবে কোরআনের প্রতি তাঁদের আস্থা বৃদ্ধি পাবে। এই বইটি হচ্ছে এক ধরনের দ্বিতীয় সাক্ষী।

যদিও এই কথাও সমানভাবে স্পষ্ট যে, আমরা খ্রীষ্টানরা দেখি যে, ওই বইয়ে কিতাবুল মোকাদ্দসের সত্যতার জোরালো সাক্ষ্যকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।

কিতাবুল মোকাদ্দসের যেসব ওহী বা ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ হয়েছে, সেগুলো ওই বইয়ে তিনি উল্লেখ করেননি।

ডঃ বুকাইলি মেনে নিতে Aস্বীকার করেছেন যে, সুখবরের লেখকরা প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন

ইঞ্জিল শরীফের প্রাচীনতম অনুলিপি সম্পর্কে কয়েক কথা বলেই সেই অনুলিপি খারিজ করে দিয়েছেন। আমাদের কাছে তিনি এই ধারণা সৃষ্টি করেছেন, বর্তমানে যে-কিতাবুল মোকাদ্দস আছে, এর বৈধতার ভালো কোনো সাক্ষী নেই।

শেষে, ইঞ্জিল শরীফকে রোনাল্ডের (Chanson de Roland) গানের সাথে তুলনা করে বলেছেন, “এই কাহিনী কাব্যে একটি সত্য ঘটনাকে রূপকথার মতো সাজিয়ে পরিবেশন করা হয়েছে।”[3]

অবশ্যই এই ধারণা খুব ভালোভাবে সেই সব মুসলমানের জন্য উপযুক্ত হবে, যাঁরা জোরালো ভাষায় বলেন যে, খ্রীষ্টানরা কিতাবুল মোকাদ্দস পরিবর্তন করেছে- অর্থাৎ ঈসা মসীহের কালাম ও জীবন সম্পর্কে বৈধতার সাক্ষী নেই। এটি খুবই মারাত্মক ও উত্তেজনা সৃষ্টিকারী অভিযোগ। উত্তর আফ্রিকায় দীর্ঘদিন থাকার সময়েই প্রায় সব মুসলমানদের কাছ থেকেই এই কথা শুনতে শুনতে আমি বিরক্ত হলেও পরে আর বিরক্ত হইনি। তবে এখন আমার মনে হয় যে, আমারই ভুল হয়েছিল।

১৯৮৩ সালে লন্ডন দিয়ে যাওয়ার সময়ে আমি বৃটিশ মিউজিয়ামে গিয়েছিলাম। সেখানে আমি ইঞ্জিল শরীফের সবচেয়ে প্রাচীন অনুলিপি Codex Sinaiticus দেখেছিলাম। এই প্রাচীন অনুলিপিটি ৩৫০ খ্রীষ্টাব্দে লেখা হয়েছিল। আমার লেখা এই বইয়েরই ১৫৫ পৃষ্ঠায় এই প্রাচীন অনুলিপিটির ছবি দেখানো হয়েছে। যাদুঘরে ঢুকে প্রহরীর কাছ থেকে পথনির্দেশ জেনে নিয়ে আমি কাঁচ দিয়ে ঘেড়া একটি বাক্সের দিকে এগিয়ে গেলাম। এগিয়ে যেতে-যেতে আমি ভাবছিলাম, আলোর প্রতিফলন ছাড়া আমি কীভাবে কাঁচের ওপর দিয়ে আমি ছবিটি তুলবো?

তারপর, আমি আমার সামনে রাখা কিতাবের পৃষ্ঠাটি দেখলাম। আমি সেই কিতাবুল মোকাদ্দসের দিকে তাকালাম, যা এখন আমার সামনে আছে। এই কিতাব সম্পর্কে আমি বহুবার অনেক লোকের কাছ থেকে শুনেছি যে, ‘তোমরা তোমাদের কিতাব পরিবর্তন করেছ।’ আর এইসব কথা এক মুহূর্তের মধ্য দিয়ে আমার মাথার মধ্য দিয়ে বয়ে গেল। আমি জোরে কেঁদে ফেললাম। এমনকি আজো যখন আমি এই বই লিখছি, তখনও আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। আমি তা ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছিলাম। এটি ছিল আমার কাছে যেন আমার ভাইকে ছু’য়ে দেখা, যে আজ থেকে ১৬০০ বছর আগে তা লিখেছিলেন। এটি ছিল বাস্তব, এমন একটি প্রমাণ যা হাত দিয়ে স্পর্শ করা যায়, যে সুখবর আগে যেমন ছিল, আজও ঠিক তেমনি আছে।

আমি তা ছুঁ’তে পারিনি। আমি তাঁদের কাছে অনুরোধ করেছিলাম, কিন্তু তাঁরা আমার আবেগ বুঝতে পারেনি যে, তাঁদের সেই অনুমতি দেওয়া উচিত ছিল। তাই আমি কেবল এর ছবি তুলে ফিরে এলাম।

আমার লেখা এই বইটি এখন আপনার হাতে আছে, তাহলে এখন এই কথা বলা যায় যে, ডঃ বুকাইলির বই এবং এই বইয়ের সাথে মূল্যায়নের সুযোগ এখন আপনার হাতে আছে। কিন্তু আসলে এর চেয়েও বড় কাজ রয়েছে। এটি একটি প্রচেষ্টা, খ্রীষ্টান ধর্ম ও ইসলামের মধ্যে গভীরতম পর্যায়ে যে মূল বিরোধ রয়েছে, তার বুদ্ধিবৃত্তি ও আবেগ এই উভয় দিকই এই বইয়ে রয়েছে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায় মুসলমানরা দাবী করেন যে, কিয়ামতের দিনে হজরত মুহাম্মদ (দঃ) তাঁদের জন্য সাফায়াত করবেন। এটি তাঁদের আবেগের কথা। তাঁরা এই কথা ভেবে নিজের দুর্দশা থেকে মুক্তি পাবার জন্য মনে-মনে সান্ত্বনা পেতে চান। কারণ, কিয়ামতের সেই দিনে একাকী আল্লাহ্‌র বিচারাসনের সামনে তাঁরা দাঁড়াতে চান না। কিন্তু তাঁদের এই ধারণা সম্পর্কে কোরআনে কি কোনো প্রমাণ আছে?

খ্রীষ্টানরা বলেন যে, আল্লাহ্ তাঁদের দুর্দশা থেকে মুক্ত করার জন্য ঈসা মসীহকে পাঠিয়েছেন। তিনি সমস্ত লোকদের পাপের জন্য জীবন-কোরবানী দিয়েছেন। যাঁরা তাঁকে নাজাতদাতা হিসেবে বিশ্বাস করেন যে, ঈসা মসীহ্‌ মৃত্যু থেকে জীবিত হয়েছেন, আর তিনি এখন তাঁদের জন্য সাফায়াত করছেন। ইঞ্জিল শরীফে কি তাঁদের এই ধারণা সম্পর্কে কোনো প্রমাণ আছে?

ওপরে যেভাবে বলা হয়েছে, মুসলমানরা জোরালো ভাষায় বলেন যে, কিতাবুল মোকাদ্দসে বদবদল করা হয়েছে। কোরআনে বা হাদিসে কিংবা ইতিহাসে কি এই সম্পর্কে কোনো প্রমাণ আছে?

যদি দুটি বই তাঁদের বক্তব্যের সাথে একমত হতে না-পারে, কীভাবে আমরা এদের মধ্যে কোনটিকে সত্য বলে বেঁছে নেব। কীভাবেই বা আমরা একজন সত্য নবীকে জানতে পারবো?

আর আমার যোগ্যতাই বা কতটুকু যে, আমি এই সব বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করতে পারি?

সবার আগে আমি পাঠকদের জানাতে চাই যে, আমিও ডঃ বুকাইলির মতো একজন ডাক্তার। দ্বিতীয়তঃ আমিও তাঁর মতো উত্তর আফ্রিকায় প্রচলিত আরবী-শিখেছি। তৃতীয়তঃ আমিও ডঃ বুকাইলির মতো কিতাবুল মোকাদ্দস ও কোরআন দুটোই পড়েছি।

এমনকি এই বইয়ে আমার অজানা অনেক বিষয় যেমন জ্যোতির্বিদ্যা, ভূতত্ত্ববিদ্যা, এমনকি মানুষের ভ্রুণতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেছি। আমি এই বিষয়গুলো নিয়ে অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞদের সাথে আলোচনা করেছি, তাঁদের মতামত নিয়েছি। আর এভাবে আমি যতদূর সম্ভব ভুল এড়াতে চেষ্টা করেছি।

যাঁদের মাতৃভাষা আরবী, আমি আমার শব্দ-অধ্যয়ন তাঁদের দেখার জন্য দিয়েছি। এতে তাঁরা বলতে পারবেন যে, আমার শব্দ-অধ্যয়ন সঠিক আছে কি-না? অন্যান্য বন্ধুরা এবং আমার স্ত্রী, যাঁরা এই পাণ্ডুলিপি পড়ে মতামত দেওয়ার জন্য সময় দিয়েছেন, তাঁদের সবাইকে আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি। নিশ্চিতভাবেই এই বইয়ে লেখা সমস্ত কিছুর জন্য দায়িত্ব আমার ঘাড়েই এসে পড়ে, আর আমি তা স্বীকারI করছি।

 

প্রাথমিক অনুমান (Basic Assumptions)

প্রথম ও দ্বিতীয় অধ্যায়ে যে কোনো বা প্রত্যেক লেখকের প্রাথমিক অনুমান বা basic assumption ও তাদের কোনো কিছুর প্রতি পক্ষপাতমূলক দৃষ্টিভংগী নিয়ে আলোচনা করেছি। আমার প্রাথমিক অনুমান বা basic assumption ও পক্ষপাতমূলক দৃষ্টিভংগী হচ্ছে, কিতাবুল মোকাদ্দস হচ্ছে একটি নির্ভুল ঐতিহাসিক কিতাব, আর সুখবর সত্য বিষয় নিয়ে লেখা হয়েছে। কোরআন ও ইঞ্জিল শরীফের অর্থ আলোচনার করার সময়ে, আমি বুঝার চেষ্টা করেছি এবং আয়াতের স্পষ্ট ব্যাখ্যা করার জন্য আমি স্থির ছিলাম – এর অর্থ এই যে, এই আয়াতগুলো নাজিলের সময়ে লোকেরা যেভাবে তার অর্থ বুঝে ছিল, আমি সেই অর্থ বলতে চেয়েছি। আমি এ কথা বলতে চাইনি যে, এই হচ্ছে আয়াতের আসল ব্যাখ্যা, এই ধরনের প্রলোভনকে আমি এড়িয়ে চলেছি। আমার নিজস্ব পক্ষপাতমূলক দৃষ্টিভংগীর মুখে লাগাম টেনে ধরার ক্ষেত্রে আমি কতদূর সফল হয়েছি, তা বিচার করার ভার আমি পাঠকের ওপরে রইল।

শেষ করার আগে আমি ব্যাখ্যা করতে চাই, কেন আমি একচেটিয়াভাবে প্রাথমিক অনুমান বা basic assumption শব্দটি ব্যবহার করেছি। আমার এক বন্ধু আমাকে পরামর্শ দিয়েছে, আমি যা বলতে চাচ্ছি তা প্রকাশ করার জন্য, বিশেষভাবে যে-অধ্যায়ে বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করেছি সেখানে এই শব্দটি সবচেয়ে উপযুক্ত বা মানানসই হয়নি। তিনি প্রস্তাব করেছেন যে শব্দটি হতে পারতো, “যুক্তিতর্কহীনভাবে পূর্ব অনুমান”, Òস্বতঃসিদ্ধ বলে স্বীকার করা”, “অগ্রাধিকার” বা “পক্ষপাতিত্ব” এর সাথে আরো যোগ করা যেতে পারে, “ভবিষৎ অনুমান” এবং “কিছু প্রমাণ করার জন্য যা সত্য বলে ধরে নেয়া বা প্রকল্প।”

এই কথা সত্যি যে, খুব গুরুত্বপূর্ণ ধারণার ক্ষেত্রে প্রাথমিক অনুমান বা basic assumptionকে বুঝানো হয়, যা একজন লোকের জীবনে ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। অথবা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কোনো “অনুমিত পরিকল্পনা দলিল” (Documentary Hypothesis) তৈরির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু অনেক জায়গায় ভবিষৎ অনুমান শব্দটি হতে পারে উপযুক্ত শব্দ, কিন্তু আমি প্রাথমিক অনুমান বা basic assumption শব্দটি ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

আমি এই শব্দটিকে ধরে রাখতে চাই। কারণ, এই প্রাথমিক অনুমান বা basic assumption শব্দটি ১৩০০ শতকের বিখ্যাত ইংরেজ দার্শনিক ওকামের উইলিয়ামের কাছ থেকে এসেছে। তিনি লিখেছেন,

“Essentia non sunt multiplicanda praeter necessitatem.”, যার মানে, “প্রাথমিক অনুমিত বিষয় বা Basic Assumptions (কোনো বস্তুর মূল স্বভাব সম্পর্কে) যেন প্রয়োজনের বাইরে বৃদ্ধি না পায়।”

এই বাক্যাংশকে বলা হয় Occam's Razor “ওকামের ক্ষুর”।   আমরা অবশ্যই এই ক্ষুর বা ছুরি দিয়ে কেটে বাদ দেব, কম করে হলেও সমস্ত অতিরিক্ত প্রাথমিক অনুমিত বিষয়গুলোকে (basic assumption) স্বীকার করে নেব।

দ্বিতীয়তঃ এটি আমাদের সামনে এই ধারণা তুলে ধরে যে, আমরা প্রতিবার একটি প্রাথমিক অনুমান তৈরি করি, এমনকি ছোট হলেও আমরা নতুন করে শুরু করি। আমাদের সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা অটল ছিলাম এবং আমরা একটি নতুন সম্ভাব্য ব্যাখ্যা খুঁজে বের করার জন্য ভেবেছি। আমরা এই সব নতুন প্রাথমিক অনুমান বা basic assumption নিয়ে সমস্যাগুলোর সমন্বয় সাধন করার চেষ্টা করেছি। তৃতীয় অংশের ১ম অধ্যায়ে আমরা দেখবো যে, হাইয়ার ক্রিটিকরা প্রাথমিকভাবে ধরে নিয়েছেন (basic assumption) যে, হজরত মূসা (আঃ) লিখতে পারতেন না। ১ম অংশের দ্বিতীয় অধ্যায়ে ডঃ বুকাইলি প্রাথমিকভাবে ধরে নিয়েছেন যে, কোরআনে ব্যবহৃত “ধোঁয়া” শব্দটি দ্বারা প্রাথমিক-গ্যাসীয়-অবস্থাকে বুঝানো হয়েছে। কিন্তু তওরাতে ব্যবহৃত পানি সম্বন্ধে খ্রীষ্টান বৈজ্ঞানিকদের ধারণা হচ্ছে তওরাতে ব্যবহৃত “পানি” শব্দটিও একই অর্থে ব্যবহার করা যেতে পারে। চতুর্থ অংশের দ্বিতীয় অধ্যায়ে আমরা দেখবো যে, ড. টর্কি সপ্তম আসমান বুঝাতে গিয়ে আরো কয়েকটি প্রাথমিক অনুমান বা basic assumption তৈরি করেছেন।

এই ধরনের কাজ করতে গেলে প্রাথমিত অনুমানগুলোকে ভুল বলা যায় না। আর এগুলো তৈরি করা পাপও নয়। এটি হচ্ছে এই সম্পর্কে শেষ কথা কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আমরা অবশ্যই প্রাথমিক অনুমান বা basic assumption তৈরি করবো, তবে এদের সংখ্যা যতদূর সম্ভব কম রাখার চেষ্টা করবো।

সবশেষে, আরবী শব্দের ব্যবহার সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলছি। মৌলানা আব্দুল্লাহ ইউসুফ আলী অনুদিত কোরআনে সূরার নামের যে অর্থ দেওয়া আছে, আমি সেই অর্থ গ্রহণ করেছি। [বাংলা অনুবাদে আমরা হরফ প্রকাশনীর কোরআন শরীফ থেকে সূরার নামের বাংলা অর্থ দিয়েছি।]

আর্ন্তজাতিক ধ্বনী নির্দেশনা অনুসারে আমি সূরার আরবী নাম ও আয়াতের আরবী শব্দ সরাসরি ইংরেজীতে অনুবাদের সময় ব্যবহার করেছি। কিন্তু চারটি ব্যতিক্রম আছে, “থ” ও “শ” শব্দের সুন্দর ইংরেজী উচ্চারণ থাকায় আমরা তাই ব্যবহার করেছি। তবু কতগুলো দুর্বল দিক রয়েছে। ফরাসী বা ইংরেজী ভাষায় অনুদিত আরবীয় লেখকদের নাম ব্যবহার করা হয়েছে, কারণ তাঁরা নিজেরাই তাঁদের নাম ল্যাটিন অক্ষরে এভাবেই লিখেছেন

হাদিসে ব্যবহৃত আরবী নামগুলো ইংরেজী ভাষায় অনুবাদের সময় একরূপ রাখা যায়নি। যেহেতু, আমি আরবী ভাষায় তাদের নাম দেখিনি, সুতরাং, আমি সাধারণতঃ ইংরেজী লেখকরা যেভাবে লিখেছেন, আমি সেভাবেই লিখেছি।

আগের যুগে অধিকাংশ আরবী শব্দ যেগুলো ইংরেজী ভাষায় ঢুকেছে আর সেগুলো সঠিক ইংরেজী বানান রয়েছে, যেমন হিজরী, শিয়া, সেগুলো আসি সেভাবেই রেখেছি। তবে, সামান্য কিছু শব্দ যেমন মুসলমান, হজরত মুহাম্মদ (দঃ) এবং কোরআন এগুলো তাদের নতুন ইংরেজী বানান রীতিতে লেখা হয়েছে। এই ধারণাগুলোকে মনে রেখেই, আসুন আমরা এখন ইতিহাস ও বিজ্ঞানের আলোকে কোরআন ও কিতাবুল মোকাদ্দস বইটি আবারও দেখি ও আবারও পরীক্ষা করি

 

স্টক শেষ

বিবরণ

ভূমিকা

 কেন একটা বইয়ের জবাব দেবার জন্য আরেকটি বই লেখা হলো?

যদিও দশ বছর আগে একটি বই প্রকাশিত হয়েছিল, তবু এত দিন পর কেন তা আবার পড়ার প্রয়োজন হলো?

ওই বইয়ে এমন কী ছিল, যার উত্তর লেখার জন্য একজন ডাক্তার ৩ বছর ওষুধপত্র থেকে দূরে ছিলেন?

ওই বইটা তিউনিশিয়ামরক্কোর প্রায় প্রতিটি বইয়ের দোকানে পাওয়া যায়

গোটা আমেরিকায় আলোড়ন তোলা সেই বইটি, যে-বইটি একজন মিশরীয় যুবকের হাতে দেখা যায়, যে যুবকটি তাঁর প্রেমিকাকে ওই বইটি পড়িয়ে প্রভাবিত করতে চায়।

ওটাই প্রথম বই যা লন্ডনের রিজেন্ট পার্কের মসজিদের বইয়ের তাকে কোরআন ও হাদিসের ঠিক নিচেই থাকে।

ওটাই প্রথম বই যা কোনো কোনো লোকের কাছে এতো মূল্যবান বলে মনে হয়েছে যে, ১৯৮৩ সাল থেকে এই বইটি মূল ফরাসী ভাষা ছাড়াও ইংরেজী, আরবী, ইন্দোনেশিয়ান, ফারশী, সার্বক্রোয়েশীয়, তুর্কী, উর্দূ, এবং গুজরাটি ভাষায় অনুদিত হয়েছে।

আমি তিউনিশীয় এক যুবকের কাছে প্রথম ওই বইটির কথা শুনি। তিনি আমাকে বলেছিলেন যে, একজন ফরাসী ডাক্তার ওই বইটি লিখেছেন। তিনি আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, “আপনি কি ডঃ মরিস বুকাইলির লেখা কিতাবুল মোকাদ্দস, কোরআন ও বিজ্ঞান বইটি পড়েছেন? তিনি ওই বইয়ে কিতাবুল মোকাদ্দস ও কোরআন সম্পর্কে অনেক কথাই বলেছেন। এমনকি তিনি এই কথাও বলেছেন যে, কোরআনে কোনো বৈজ্ঞানিক ভুল নেই।”

আমি যখন ডঃ বুকাইলির লেখা ওই বইটি পড়ছিলাম, আমি দেখেছিলাম যে, আসলেই তিনি কিতাবুল মোকাদ্দস ও কোরআন সম্পর্কে অনেক কথাই বলেছেন। তিনি বলেছেন,

“আএরপর আমি আরবী ভাষা শিখি এবং অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে কোরআনের আয়াতসমূহ পরীক্ষা করতে শুরু করি .. আমি এই স্থির সিদ্ধান্তে উপনিত হই যে, কোরআনে এমন একটাও বক্তব্য নেই যে বক্তব্যকে আধুনিক বৈজ্ঞানিক বিচারে খন্ডন করা যেতে পারে [1]

এর পাশাপাশি কিতাবুল মোকাদ্দসের কথার বলার সময়ে বলেছেন, তিনি কেবল একে ‘বৈপরিত্ত,অসঙ্গত অবিশ্বাসযোগ্য কথা রয়েছে। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন যে, কিতাবুল মোকাদ্দস বিশেষজ্ঞরা তা এড়িয়ে গেছেন, আর যখন তারা ওইগুলো উল্লেখ করেছেন, তাঁরা তখন শব্দের মারপ্যাচে তা ধামাচাপা দেবার চেষ্টা করেছেন।[2]

ডঃ বুকাইলির বইটি পড়ে, স্পষ্টতই মুসলমানরা রোমাঞ্চিত হবেন, কারণ, যদি তা সত্য হয়, তবে কোরআনের প্রতি তাঁদের আস্থা বৃদ্ধি পাবে। এই বইটি হচ্ছে এক ধরনের দ্বিতীয় সাক্ষী।

যদিও এই কথাও সমানভাবে স্পষ্ট যে, আমরা খ্রীষ্টানরা দেখি যে, ওই বইয়ে কিতাবুল মোকাদ্দসের সত্যতার জোরালো সাক্ষ্যকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।

কিতাবুল মোকাদ্দসের যেসব ওহী বা ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ হয়েছে, সেগুলো ওই বইয়ে তিনি উল্লেখ করেননি।

ডঃ বুকাইলি মেনে নিতে Aস্বীকার করেছেন যে, সুখবরের লেখকরা প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন

ইঞ্জিল শরীফের প্রাচীনতম অনুলিপি সম্পর্কে কয়েক কথা বলেই সেই অনুলিপি খারিজ করে দিয়েছেন। আমাদের কাছে তিনি এই ধারণা সৃষ্টি করেছেন, বর্তমানে যে-কিতাবুল মোকাদ্দস আছে, এর বৈধতার ভালো কোনো সাক্ষী নেই।

শেষে, ইঞ্জিল শরীফকে রোনাল্ডের (Chanson de Roland) গানের সাথে তুলনা করে বলেছেন, “এই কাহিনী কাব্যে একটি সত্য ঘটনাকে রূপকথার মতো সাজিয়ে পরিবেশন করা হয়েছে।”[3]

অবশ্যই এই ধারণা খুব ভালোভাবে সেই সব মুসলমানের জন্য উপযুক্ত হবে, যাঁরা জোরালো ভাষায় বলেন যে, খ্রীষ্টানরা কিতাবুল মোকাদ্দস পরিবর্তন করেছে- অর্থাৎ ঈসা মসীহের কালাম ও জীবন সম্পর্কে বৈধতার সাক্ষী নেই। এটি খুবই মারাত্মক ও উত্তেজনা সৃষ্টিকারী অভিযোগ। উত্তর আফ্রিকায় দীর্ঘদিন থাকার সময়েই প্রায় সব মুসলমানদের কাছ থেকেই এই কথা শুনতে শুনতে আমি বিরক্ত হলেও পরে আর বিরক্ত হইনি। তবে এখন আমার মনে হয় যে, আমারই ভুল হয়েছিল।

১৯৮৩ সালে লন্ডন দিয়ে যাওয়ার সময়ে আমি বৃটিশ মিউজিয়ামে গিয়েছিলাম। সেখানে আমি ইঞ্জিল শরীফের সবচেয়ে প্রাচীন অনুলিপি Codex Sinaiticus দেখেছিলাম। এই প্রাচীন অনুলিপিটি ৩৫০ খ্রীষ্টাব্দে লেখা হয়েছিল। আমার লেখা এই বইয়েরই ১৫৫ পৃষ্ঠায় এই প্রাচীন অনুলিপিটির ছবি দেখানো হয়েছে। যাদুঘরে ঢুকে প্রহরীর কাছ থেকে পথনির্দেশ জেনে নিয়ে আমি কাঁচ দিয়ে ঘেড়া একটি বাক্সের দিকে এগিয়ে গেলাম। এগিয়ে যেতে-যেতে আমি ভাবছিলাম, আলোর প্রতিফলন ছাড়া আমি কীভাবে কাঁচের ওপর দিয়ে আমি ছবিটি তুলবো?

তারপর, আমি আমার সামনে রাখা কিতাবের পৃষ্ঠাটি দেখলাম। আমি সেই কিতাবুল মোকাদ্দসের দিকে তাকালাম, যা এখন আমার সামনে আছে। এই কিতাব সম্পর্কে আমি বহুবার অনেক লোকের কাছ থেকে শুনেছি যে, ‘তোমরা তোমাদের কিতাব পরিবর্তন করেছ।’ আর এইসব কথা এক মুহূর্তের মধ্য দিয়ে আমার মাথার মধ্য দিয়ে বয়ে গেল। আমি জোরে কেঁদে ফেললাম। এমনকি আজো যখন আমি এই বই লিখছি, তখনও আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। আমি তা ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছিলাম। এটি ছিল আমার কাছে যেন আমার ভাইকে ছু’য়ে দেখা, যে আজ থেকে ১৬০০ বছর আগে তা লিখেছিলেন। এটি ছিল বাস্তব, এমন একটি প্রমাণ যা হাত দিয়ে স্পর্শ করা যায়, যে সুখবর আগে যেমন ছিল, আজও ঠিক তেমনি আছে।

আমি তা ছুঁ’তে পারিনি। আমি তাঁদের কাছে অনুরোধ করেছিলাম, কিন্তু তাঁরা আমার আবেগ বুঝতে পারেনি যে, তাঁদের সেই অনুমতি দেওয়া উচিত ছিল। তাই আমি কেবল এর ছবি তুলে ফিরে এলাম।

আমার লেখা এই বইটি এখন আপনার হাতে আছে, তাহলে এখন এই কথা বলা যায় যে, ডঃ বুকাইলির বই এবং এই বইয়ের সাথে মূল্যায়নের সুযোগ এখন আপনার হাতে আছে। কিন্তু আসলে এর চেয়েও বড় কাজ রয়েছে। এটি একটি প্রচেষ্টা, খ্রীষ্টান ধর্ম ও ইসলামের মধ্যে গভীরতম পর্যায়ে যে মূল বিরোধ রয়েছে, তার বুদ্ধিবৃত্তি ও আবেগ এই উভয় দিকই এই বইয়ে রয়েছে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায় মুসলমানরা দাবী করেন যে, কিয়ামতের দিনে হজরত মুহাম্মদ (দঃ) তাঁদের জন্য সাফায়াত করবেন। এটি তাঁদের আবেগের কথা। তাঁরা এই কথা ভেবে নিজের দুর্দশা থেকে মুক্তি পাবার জন্য মনে-মনে সান্ত্বনা পেতে চান। কারণ, কিয়ামতের সেই দিনে একাকী আল্লাহ্‌র বিচারাসনের সামনে তাঁরা দাঁড়াতে চান না। কিন্তু তাঁদের এই ধারণা সম্পর্কে কোরআনে কি কোনো প্রমাণ আছে?

খ্রীষ্টানরা বলেন যে, আল্লাহ্ তাঁদের দুর্দশা থেকে মুক্ত করার জন্য ঈসা মসীহকে পাঠিয়েছেন। তিনি সমস্ত লোকদের পাপের জন্য জীবন-কোরবানী দিয়েছেন। যাঁরা তাঁকে নাজাতদাতা হিসেবে বিশ্বাস করেন যে, ঈসা মসীহ্‌ মৃত্যু থেকে জীবিত হয়েছেন, আর তিনি এখন তাঁদের জন্য সাফায়াত করছেন। ইঞ্জিল শরীফে কি তাঁদের এই ধারণা সম্পর্কে কোনো প্রমাণ আছে?

ওপরে যেভাবে বলা হয়েছে, মুসলমানরা জোরালো ভাষায় বলেন যে, কিতাবুল মোকাদ্দসে বদবদল করা হয়েছে। কোরআনে বা হাদিসে কিংবা ইতিহাসে কি এই সম্পর্কে কোনো প্রমাণ আছে?

যদি দুটি বই তাঁদের বক্তব্যের সাথে একমত হতে না-পারে, কীভাবে আমরা এদের মধ্যে কোনটিকে সত্য বলে বেঁছে নেব। কীভাবেই বা আমরা একজন সত্য নবীকে জানতে পারবো?

আর আমার যোগ্যতাই বা কতটুকু যে, আমি এই সব বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করতে পারি?

সবার আগে আমি পাঠকদের জানাতে চাই যে, আমিও ডঃ বুকাইলির মতো একজন ডাক্তার। দ্বিতীয়তঃ আমিও তাঁর মতো উত্তর আফ্রিকায় প্রচলিত আরবী-শিখেছি। তৃতীয়তঃ আমিও ডঃ বুকাইলির মতো কিতাবুল মোকাদ্দস ও কোরআন দুটোই পড়েছি।

এমনকি এই বইয়ে আমার অজানা অনেক বিষয় যেমন জ্যোতির্বিদ্যা, ভূতত্ত্ববিদ্যা, এমনকি মানুষের ভ্রুণতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেছি। আমি এই বিষয়গুলো নিয়ে অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞদের সাথে আলোচনা করেছি, তাঁদের মতামত নিয়েছি। আর এভাবে আমি যতদূর সম্ভব ভুল এড়াতে চেষ্টা করেছি।

যাঁদের মাতৃভাষা আরবী, আমি আমার শব্দ-অধ্যয়ন তাঁদের দেখার জন্য দিয়েছি। এতে তাঁরা বলতে পারবেন যে, আমার শব্দ-অধ্যয়ন সঠিক আছে কি-না? অন্যান্য বন্ধুরা এবং আমার স্ত্রী, যাঁরা এই পাণ্ডুলিপি পড়ে মতামত দেওয়ার জন্য সময় দিয়েছেন, তাঁদের সবাইকে আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি। নিশ্চিতভাবেই এই বইয়ে লেখা সমস্ত কিছুর জন্য দায়িত্ব আমার ঘাড়েই এসে পড়ে, আর আমি তা স্বীকারI করছি।

 

প্রাথমিক অনুমান (Basic Assumptions)

প্রথম ও দ্বিতীয় অধ্যায়ে যে কোনো বা প্রত্যেক লেখকের প্রাথমিক অনুমান বা basic assumption ও তাদের কোনো কিছুর প্রতি পক্ষপাতমূলক দৃষ্টিভংগী নিয়ে আলোচনা করেছি। আমার প্রাথমিক অনুমান বা basic assumption ও পক্ষপাতমূলক দৃষ্টিভংগী হচ্ছে, কিতাবুল মোকাদ্দস হচ্ছে একটি নির্ভুল ঐতিহাসিক কিতাব, আর সুখবর সত্য বিষয় নিয়ে লেখা হয়েছে। কোরআন ও ইঞ্জিল শরীফের অর্থ আলোচনার করার সময়ে, আমি বুঝার চেষ্টা করেছি এবং আয়াতের স্পষ্ট ব্যাখ্যা করার জন্য আমি স্থির ছিলাম – এর অর্থ এই যে, এই আয়াতগুলো নাজিলের সময়ে লোকেরা যেভাবে তার অর্থ বুঝে ছিল, আমি সেই অর্থ বলতে চেয়েছি। আমি এ কথা বলতে চাইনি যে, এই হচ্ছে আয়াতের আসল ব্যাখ্যা, এই ধরনের প্রলোভনকে আমি এড়িয়ে চলেছি। আমার নিজস্ব পক্ষপাতমূলক দৃষ্টিভংগীর মুখে লাগাম টেনে ধরার ক্ষেত্রে আমি কতদূর সফল হয়েছি, তা বিচার করার ভার আমি পাঠকের ওপরে রইল।

শেষ করার আগে আমি ব্যাখ্যা করতে চাই, কেন আমি একচেটিয়াভাবে প্রাথমিক অনুমান বা basic assumption শব্দটি ব্যবহার করেছি। আমার এক বন্ধু আমাকে পরামর্শ দিয়েছে, আমি যা বলতে চাচ্ছি তা প্রকাশ করার জন্য, বিশেষভাবে যে-অধ্যায়ে বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করেছি সেখানে এই শব্দটি সবচেয়ে উপযুক্ত বা মানানসই হয়নি। তিনি প্রস্তাব করেছেন যে শব্দটি হতে পারতো, “যুক্তিতর্কহীনভাবে পূর্ব অনুমান”, Òস্বতঃসিদ্ধ বলে স্বীকার করা”, “অগ্রাধিকার” বা “পক্ষপাতিত্ব” এর সাথে আরো যোগ করা যেতে পারে, “ভবিষৎ অনুমান” এবং “কিছু প্রমাণ করার জন্য যা সত্য বলে ধরে নেয়া বা প্রকল্প।”

এই কথা সত্যি যে, খুব গুরুত্বপূর্ণ ধারণার ক্ষেত্রে প্রাথমিক অনুমান বা basic assumptionকে বুঝানো হয়, যা একজন লোকের জীবনে ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। অথবা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কোনো “অনুমিত পরিকল্পনা দলিল” (Documentary Hypothesis) তৈরির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু অনেক জায়গায় ভবিষৎ অনুমান শব্দটি হতে পারে উপযুক্ত শব্দ, কিন্তু আমি প্রাথমিক অনুমান বা basic assumption শব্দটি ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

আমি এই শব্দটিকে ধরে রাখতে চাই। কারণ, এই প্রাথমিক অনুমান বা basic assumption শব্দটি ১৩০০ শতকের বিখ্যাত ইংরেজ দার্শনিক ওকামের উইলিয়ামের কাছ থেকে এসেছে। তিনি লিখেছেন,

“Essentia non sunt multiplicanda praeter necessitatem.”, যার মানে, “প্রাথমিক অনুমিত বিষয় বা Basic Assumptions (কোনো বস্তুর মূল স্বভাব সম্পর্কে) যেন প্রয়োজনের বাইরে বৃদ্ধি না পায়।”

এই বাক্যাংশকে বলা হয় Occam’s Razor “ওকামের ক্ষুর”।   আমরা অবশ্যই এই ক্ষুর বা ছুরি দিয়ে কেটে বাদ দেব, কম করে হলেও সমস্ত অতিরিক্ত প্রাথমিক অনুমিত বিষয়গুলোকে (basic assumption) স্বীকার করে নেব।

দ্বিতীয়তঃ এটি আমাদের সামনে এই ধারণা তুলে ধরে যে, আমরা প্রতিবার একটি প্রাথমিক অনুমান তৈরি করি, এমনকি ছোট হলেও আমরা নতুন করে শুরু করি। আমাদের সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা অটল ছিলাম এবং আমরা একটি নতুন সম্ভাব্য ব্যাখ্যা খুঁজে বের করার জন্য ভেবেছি। আমরা এই সব নতুন প্রাথমিক অনুমান বা basic assumption নিয়ে সমস্যাগুলোর সমন্বয় সাধন করার চেষ্টা করেছি। তৃতীয় অংশের ১ম অধ্যায়ে আমরা দেখবো যে, হাইয়ার ক্রিটিকরা প্রাথমিকভাবে ধরে নিয়েছেন (basic assumption) যে, হজরত মূসা (আঃ) লিখতে পারতেন না। ১ম অংশের দ্বিতীয় অধ্যায়ে ডঃ বুকাইলি প্রাথমিকভাবে ধরে নিয়েছেন যে, কোরআনে ব্যবহৃত “ধোঁয়া” শব্দটি দ্বারা প্রাথমিক-গ্যাসীয়-অবস্থাকে বুঝানো হয়েছে। কিন্তু তওরাতে ব্যবহৃত পানি সম্বন্ধে খ্রীষ্টান বৈজ্ঞানিকদের ধারণা হচ্ছে তওরাতে ব্যবহৃত “পানি” শব্দটিও একই অর্থে ব্যবহার করা যেতে পারে। চতুর্থ অংশের দ্বিতীয় অধ্যায়ে আমরা দেখবো যে, ড. টর্কি সপ্তম আসমান বুঝাতে গিয়ে আরো কয়েকটি প্রাথমিক অনুমান বা basic assumption তৈরি করেছেন।

এই ধরনের কাজ করতে গেলে প্রাথমিত অনুমানগুলোকে ভুল বলা যায় না। আর এগুলো তৈরি করা পাপও নয়। এটি হচ্ছে এই সম্পর্কে শেষ কথা কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আমরা অবশ্যই প্রাথমিক অনুমান বা basic assumption তৈরি করবো, তবে এদের সংখ্যা যতদূর সম্ভব কম রাখার চেষ্টা করবো।

সবশেষে, আরবী শব্দের ব্যবহার সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলছি। মৌলানা আব্দুল্লাহ ইউসুফ আলী অনুদিত কোরআনে সূরার নামের যে অর্থ দেওয়া আছে, আমি সেই অর্থ গ্রহণ করেছি। [বাংলা অনুবাদে আমরা হরফ প্রকাশনীর কোরআন শরীফ থেকে সূরার নামের বাংলা অর্থ দিয়েছি।]

আর্ন্তজাতিক ধ্বনী নির্দেশনা অনুসারে আমি সূরার আরবী নাম ও আয়াতের আরবী শব্দ সরাসরি ইংরেজীতে অনুবাদের সময় ব্যবহার করেছি। কিন্তু চারটি ব্যতিক্রম আছে, “থ” ও “শ” শব্দের সুন্দর ইংরেজী উচ্চারণ থাকায় আমরা তাই ব্যবহার করেছি। তবু কতগুলো দুর্বল দিক রয়েছে। ফরাসী বা ইংরেজী ভাষায় অনুদিত আরবীয় লেখকদের নাম ব্যবহার করা হয়েছে, কারণ তাঁরা নিজেরাই তাঁদের নাম ল্যাটিন অক্ষরে এভাবেই লিখেছেন

হাদিসে ব্যবহৃত আরবী নামগুলো ইংরেজী ভাষায় অনুবাদের সময় একরূপ রাখা যায়নি। যেহেতু, আমি আরবী ভাষায় তাদের নাম দেখিনি, সুতরাং, আমি সাধারণতঃ ইংরেজী লেখকরা যেভাবে লিখেছেন, আমি সেভাবেই লিখেছি।

আগের যুগে অধিকাংশ আরবী শব্দ যেগুলো ইংরেজী ভাষায় ঢুকেছে আর সেগুলো সঠিক ইংরেজী বানান রয়েছে, যেমন হিজরী, শিয়া, সেগুলো আসি সেভাবেই রেখেছি। তবে, সামান্য কিছু শব্দ যেমন মুসলমান, হজরত মুহাম্মদ (দঃ) এবং কোরআন এগুলো তাদের নতুন ইংরেজী বানান রীতিতে লেখা হয়েছে। এই ধারণাগুলোকে মনে রেখেই, আসুন আমরা এখন ইতিহাস ও বিজ্ঞানের আলোকে কোরআন ও কিতাবুল মোকাদ্দস বইটি আবারও দেখি ও আবারও পরীক্ষা করি

অন্যান্য তথ্য

লেখক

বাইন্ডিং

পৃষ্ঠা

সংস্করণ

প্রকাশকাল

রিভিউ

এখনও কোন রিভিউ নেই।

প্রথম ব্যাক্তি হিসেবে রিভিউ করুনঃ “কোরআন ও কিতাবুল মোকাদ্দস: ইতিহাস ও বিজ্ঞানের আলোকে”

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।