সংক্ষিপ্ত উত্তর:
হ্যাঁ, ঈসায়ীরাও মুসলমান পরিচয় দিতে পারে।
ব্যাখ্যামূলক উত্তর:
সাধারণত মানুষ জন্মের মাধ্যমেই পরিচয় লাভ করে। যার মা-বাবা যে ধর্মে বিশ্বাসী সাধারণত জন্মগ্রহণকারী ব্যক্তি সেই ধর্মের লোক বলে পরিচয় দেয়। আবার ধর্ম পরিবর্তন করে কেউ কেউ নতুন পরিচয়ে পরিচিত হয়। আবার এমন অনেকে আছে, যারা ধর্মীয় পরিচয়ে পরিচিত হতে চায় না। তাদের কেউ কেউ মানবতাবাদী, কেউ কেউ সাম্যবাদী আবার কেউ কেউ কমিউনিস্ট হিসেবেও নিজেদের পরিচিত করতে চায়।
নিজের পরিচয় নিজেকেই ঠিক করতে হয়। কে কীভাবে পরিচিত হবে তা নিজের উপরই নির্ভর করে। মিথ্যা পরিচয় দেবার মধ্যে কোন বিশেষত্ব নেই বরং তাতে কাপুরুষতা প্রকাশ পায়। অনেকে প্রশ্নের সম্মুখী না হওয়ার কিংবা ঝামেলা এড়ানোর জন্য নিজ পরিচয় গোপন করে। জীবন রক্ষার তাগিদেও কেউ কেউ পরিচয় গোপন করে কিংবা ভিন্ন পরিচয়ে পরিচিত হয়। যেমন আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিাস্তানি হানাদারদের অত্যাচারে, প্রাণের ভয়ে কমল চন্দ্র হয়ে গিয়েছিল কামাল চান; আর হরভজন হয়েছিল হাসান চৌধুরী। এছাড়া সার্থসিদ্ধির জন্য যে কেউ ভিন্ন পরিচয় দেয় না তাও নয়। পাক-ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস থেকে জানা যায়, মুঘল আমলে, ব্রিটিশ আমলে, পাকিস্তান আমলে অনেকে আর্থিক ও রাজনৈতিক সুযোগ-সুবিধা লাভের জন্য নিজের আসল পরিচয় গোপন করে নতুন ও ভিন্ন পরিচয়ে পরিচিত হয়েছিল এবং কাক্সিক্ষত সুযোগ-সুবিধা লাভ করেছিল।
কোন মুসলমান ভাইকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় হজরত আদম, নুহ, ইবরাহিম, ইসহাক, ইয়াকুব, মুসা, দাউদ, ঈসা ইত্যাদী নবিগণ কোন্ ধর্মের লোক ছিলেন? তারা নির্দ্বিধায় উত্তর দেবেন, মুসলমান। এরপর যদি তাদের জিজ্ঞাসা করা হয় যে, সেইসব নবিদের উম্মতেরা কোন্ ধর্মের লোক ছিলেন, তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চিন্তা করে এক একজন এক একরকম উত্তর দেবেন। এর কারণ হলো, হজরত আদম, নুহ, ইব্রাহিম, ইসহাক ছাড়া বাস্তবে উপরিউক্ত নবিদের কেউ জাতিগতভাবে মুসলমান ছিলেন না। তারা প্রায় সকলেই ইহুদি বা ইসরাইল ছিলেন। আল্লাহপাক হজরত ইয়াকুবকে তাঁর নাম পরিবর্তন করে, ইসরাইল রেখেছিলেন। তারপর থেকেই ইসরাইল জাতির সূচনা হয়। তবে বনিইসরাইল বা ইহুদিরা হজরত ইবরাহিমকেই জাতির পিতা বলে দাবি করে। সেই দিক থেকে ইবরাহিমকেও ইসরাইল (মনোনীত) বলা যায়। এছাড়া আল্লাহ নিজেই হজরত ইবরাহিমকে ইসরাইল জাতির তথা তাঁর লোকদের পিতৃপুরুষ হবার জন্য মনোনীত করেছিলেন।
মুসলমান ভাইয়েরা দাবি করেন, ইবরাহিম তাদেরই একজন নবি, সেই দিক থেকে তিনি মুসলমান। তাত্ত্বিক দিক থেকেও তাঁকে মুসলমান বলা যায়, কেননা তিনিই যথার্থ উপায়ে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। বর্তমানে অনেক ঈসায়ী নিজেদের মুসলমান পরিচয় দিতে চায় এবং দেয়। এই পরিচয়ও তাত্ত্বিক দিক থেকে তো বটে ঈমানি সত্যের দিক থেকেও যথার্থ। ঈসায়ীরাও হজরত ঈসাকে তাদের একজন নবি হিসেবে বিশ্বাস করে ও মানে। হজরত ইবরাহিমকে যদি মুসলমান বলা যায়, তবে একজন ঈসায়ী অবশ্যই মুসলমান। কেননা ঈসায়ীরা হজরত ইবরাহিমকে কেবল নবি হিসেবে নয়, তাদের আদি পিতৃপুরুষ হিসাবেও বিশ্বাস করে। মূসলমান মানে আত্মসমর্পণকারী। হজরত ইবরাহিম বাধ্যতার মধ্য দিয়ে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। প্রথমত: তিনি আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে নিজের দেশ, আত্মীয়-স্বজন ও পৈতৃক ভিটেমাটি ছেড়ে, অজানা দেশের উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন। দ্বিতীয়ত: তিনি সন্তান পাবার জন্য আল্লাহর প্রতিজ্ঞার প্রতি নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন। তৃতীয়ত: নিজের একমাত্র প্রিয় ছেলের কোরবানির মধ্য দিয়ে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন।
হজরত ঈসা মসীহও আল্লাহর বাধ্য হয়েই নিজেকে সম্পূর্ণ নিচু করেছিলেন, গোলামের রূপ ধারণ করেছিলেন, মৃত্যু পর্যন্ত এমন কি ক্রুশে মহাযন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু পর্যন্ত নিজেকে আল্লাহর কাছে সমর্পণ করেছিলেন। ঈসায়ীদের জীবন মানে সমর্পিত জীবন, কোরবানির জীবন। বাহ্যিক ধর্মকর্ম ঈসায়ীদের মৌলিক বৈশিষ্ট্য নয়, বৈশিষ্ট্য হলো সমর্পণ। ঈসায়ীদের মূলকাজ হলো আল্লাহকে মহব্বত করা এবং মানুষকে মহব্বত করা। সেই মহব্বত কেমন? আল্লাহ যেমন মানুষকে মহব্বত করে মসীহকে কোরবানি হিসাবে সমর্পণ করেছিলেন। আবার মসীহ যেমন তাঁর উম্মতদের ভালোবেসে নিজেকে কোরবানি দিয়েছিলেন তেমনি সমর্পণ। ইঞ্জিল শরিফ বলে, “…তোমরা তোমাদের দেহকে জীবিত, পবিত্র ও আল্লাহর গ্রহণযোগ্য কোরবানি হিসেবে আল্লাহর হাতে তুলে দাও।” আমাদের বলা হয়েছে, কেউ এক গালে চড় দিলে, আমরা যেন আর এক গাল পেতে দিই, কেউ এক মাইল যেতে বললে, আমরা যেন দুই মাইল যাই, আর কেউ শত্রুতা করলে, আমরা যেন তাকে মহব্বত করি। তাই ঈসায়ীদের জীবন মানে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের জীবন। অতএব, এই দৃষ্টিকোন থেকে একজন ঈসায়ী নিজেকে মুসলমান দাবি করতে পারে, কোন সন্দেহ নেই।
মুসলমান শব্দের উৎপত্তি সালাম শব্দ থেকে। সালাম মানে শান্তি। হজরত ঈসা বলেন, আমি তোমাদের শান্তি দিতে এসেছি, আর আমারই শান্তি আমি তোমাদের জন্য রেখে যাচ্ছি। তিনি নিজে যেখানে যেতেন সালাম জানাতেন এবং সাহাবিদের শিক্ষা দিতেন যেন তারা কোথাও গেলে অন্যদের সালাম জানায়। এছাড়া মানুষের শান্তির জন্য তিনি তাঁর সারাটি জীবন ব্যয় করেছিলেন; অসুস্থকে সুস্থ হবার সুযোগ, বোবাকে কথা বলার সুযোগ, কালাকে বলার সুযোগ, খোঁড়াকে চলার সুযোগ, অন্ধকে দেখার সুযোগ এমনকি মৃতকে বাঁচার সুযোগ করে দিয়ে শান্তি স্থাপন করেছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা হলো, মানুষের অনন্ত শান্তির জন্যই তিনি তাঁর নিজের জীবন কোরবানি দিয়েছিলেন। আর ঈসায়ীরা সেই মসীহেরই উম্মত হিসেবে অবশ্যই মুসলমান পরিচয় দিতে পারে। কারণ তাদের কাছে প্রকৃত মুসলমানের সালাম বা শান্তি আছে।
কোরান শরিফের সুরা আল ইমরান ৩:৩২ আয়াতে হজরত ঈসার উম্মতদের আত্মসমর্পণকারী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। লেখা আছে, “ঈসা যখন তাদের অবিশ্বাস উপলব্ধি করল তখন সে বলল, আল্লাহর পথে কারা আমার সাহায্যকারী? হাওয়ারিগণ (ঈসা মসীহের আসল অনুসারী) বলল, ‘আমরাই আল্লাহর পথে সাহায্যকারী। আমরা আল্লাহর উপর ঈমান এনেছি। আমরা আত্মসমর্পণকারী, তুমি এর সাক্ষী।’ শুধু তা নয়, কোরান শরিফে হজরত ঈসার অনুসরণকারীদের সরাসরি মুসলিমও বলা হয়েছে। লেখা আছে, “আরও স্মরণ কর, আমি যখন হাওয়ারীদেরকে (ঈসা মসীহের আসল অনুসারী) এই আদেশ দিয়েছিলাম যে, তোমরা আমার প্রতি ও আমার রাসুলের প্রতি ঈমান আন, তারা বলেছিল, আমরা ঈমান আনলাম এবং তুমি সাক্ষি থাক যে, আমরা তো মুসলিম” (সুরা মায়িদা ৫:১১১)।