দুইশ’ বছর আগে বাংলা ভাষার প্রথম ‘মাতৃভাষা আন্দোলন’ করেছিলেন ঈসা মসীহ্র অনুসারীদের একটি ছোট দল। এই প্রথম মাতৃভাষার আন্দোলনের শুরু হয় প্রধানত একজন গরিব স্বশিক্ষিত মুচির দ্বারা। তাঁর নাম উইলিয়ম কেরী, এবং বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষে বাংলাপিডিয়া-তে কেরীকে বলা হয়েছে, ‘বাংলা গদ্যের জনক’ এবং ‘শ্রীরামপুরে নবজাগরণের স্রষ্টা’। “উনবিংশ শতকে বাংলা সাহিত্য” গ্রন্থে অধ্যাপক এস.কে. দে বলেন যে কেরী এবং তার সহকর্মীরা “বাংলা ভাষাকে ভাঙ্গা এবং অবহেলিত আঞ্চলিক উপভাষার স্তর থেকে তুলে সেটাকে তারা সমাজের একটি স্বীকৃত ও স্থায়ী আধুনিক ভাষায় পরিণত করেছেন।” বাংলাপিডিয়া আরো বলে:
“…এ ক্ষেত্রে অবশ্য কেরীর অবদানই বেশী। বাংলা ভাষার উৎকর্ষ সাধনে কেরী যে অবদান রাখেন, তার জন্য তিনি বঙ্গদেশ ও বাংলা ভাষার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন।” (বাংলাপিডিয়া, “বাংলা সাহিত্য”)
কেরী তাঁর ষোল বছর বয়সে কিতাবুল মোকাদ্দস পড়ে ঈসা মসীহ্র শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং ঈসার আদর্শের পথে নিজেকে উৎসর্গ করেন। তাঁর সম্বন্ধে নিচে বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ ‘বাংলাপিডিয়া’ থেকে বিস্তূত উদ্ধৃতি দেওয়া হলো:
“দারিদ্র্যের কারণে উচ্চশিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত কেরীকে জীবিকার জন্য জুতা তৈরির কারখানায় কাজ করতে হয়। ষোলো বছর বয়সে ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তিনি ল্যাটিন, গ্রিক ও হিব্রু ভাষা এবং ইতিহাস, ভূগোল, ভ্রমণকাহিনী, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে জ্ঞান অর্জ করেন। (বাংলাপেডিয়া, “কেরী, উইলিয়ম”)
ভূগোল অধ্যয়ন করে কেরী জানতে পারেন যে তখনও কিতাবুল মোকাদ্দস ভারতবর্ষের বেশির ভাগ ভাষায় অনুবাদ করা হয় নি। এই জন্যে কেরী মনে মনে ঠিক করেন ঈসা মসীহ্র শেষ হুকুম (বিভিন্ন জাতির কাছে সুসংবাদ তবলীগ করা) অনুসারে তিনি ভারতে আগমন করবেন। ভারতে আসার পূর্বে ইংল্যাণ্ডে থাকা কালেই, কিতাবুল মোকাদ্দস সঠিকভাবে মূল ভাষা থেকে অনুবাদ করার উদ্দেশ্যে তিনি হিব্রু ও গ্রিক ভাষা শিখে নিয়েছিলেন।
মিশনবিরোধী ইংরেজ সরকারের বিতাড়ন এড়াতে কেরী দিনেমার উপনিবেশ শ্রীরামপুরে আশ্রয় নেন। সেখানে তিনি মৃত্য পর্যন্ত থাকলেন। ১৭৯৯ সালে জশুয়া মার্শম্যান ও উইলিয়ম ওয়ার্ড মিশনেরিরা কেরীর সাথে একটি প্রেস স্থাপন করেন এবং এই “শ্রীরামপুর ত্রয়ী” একসাথে প্রায় চল্লিশ বছরে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন বাংলা ভাষা ও গণশিক্ষার উৎকর্ষ সাধন করার জন্যে।
প্রথম বাংলা গ্রন্থ
ইতিহাসে বাংলা হরফে মুদ্রিত প্রথম গ্রন্থ ছিল কেরীর মঙ্গল সমাচার (ইঞ্জিল শরীফের বঙ্গানুবাদ):
“এভাবে আগস্ট মাসের মধ্যেই নিউটেস্টামেন্টের সেন্টম্যাথুজ ছাপা হয়। মথীয়ের রচনায় মঙ্গল সমাচার নামে এটি প্রকাশ করা হয়। এটি বাংলা হরফে মুদ্রিত প্রথম গ্রন্থ। (বাংলাপেডিয়া, “শ্রীরামপুর মিশন প্রেস”)
প্রথম বাংলা সংবাদপত্র
বাংলা ভাষায় সর্বপ্রথম প্রকাশিত সংবাদপত্রও ছিল কেরীর কাজ:
“বাংলায় সাময়িক পত্র-পত্রিকা এবং সংবাদপত্রের সূচনা বাংলা গদ্যের ইতিহাসকে বিনির্মাণ ও নিয়ন্ত্রণ করেছে। বাংলা সাহিত্যের ক্রমবিকাশে উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে বিবিধ সাময়িক পত্র-পত্রিকা নানাভাবে সাহায্য করেছে, যার ধারা একাল পর্যন্ত অব্যাহত। শ্রীরামপুরের পাদ্রিরা প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশের কৃতিত্ব অর্জন করেন…” (বাংলাপিডিয়া, “বাংলা সাহিত্য”)
প্রথম বাংলা সাময়িক পত্র
বাংলা ভাষায় প্রকাশিত সর্বপ্রথম সাময়িক পত্র, ‘দিগ্দর্শন’ ছিল কেরীর শ্রীরামপুর মিশন প্রেসের উদ্যোগ:
“প্রথম দিকে পত্রিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে মুদ্রণযন্ত্র, হরফের অভাব ইত্যাদি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছিল প্রধান প্রতিবন্ধক। কারণ ঐ সময় যাঁরা পত্র-পত্রিকা প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন তাঁরা কেউ কোম্পানির চাকুরে ছিলেন না। কোম্পানির সঙ্গে ছিল তাঁদের স্বার্থগত এবং নীতিগত বিরোধ। … বাংলা সংবাদ-সাময়িকপত্র প্রকাশের প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেন শ্রীরামপুর ব্যাপ্টিস্ট মিশনারিরা। ১৮১৮ সালে মিশনের পক্ষে জন ক্লার্ক মার্শম্যানের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় প্রথম বাংলা সাময়িক পত্র দিগ্দর্শন। … দিগ্দর্শন প্রকাশিত হওয়ার একমাস পর (২৩ মে, ১৮১৮) মার্শম্যান প্রকাশ করেন সমাচার দর্পণ। (বাংলাপিডিয়া, “সংবাদপত্র”)
শ্রীরামপুরের ধর্মপ্রচারকগণ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও পথিকৃৎ ছিলেন। জে. সি. মার্শম্যানের দিগ্দর্শন, ম্যাগাজিন ফর ইন্ডিয়ান ইয়ুথ (ইংরেজি ও বাংলায়), সমাচার দর্পণ (১৮১৮ সালে প্রকাশিত) ও দি ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া (ঐ একই সালে প্রকাশিত) কতিপয় সমকালীন সামাজিক সমস্যার প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।” (বাংলাপিডিয়া, “খ্রিষ্টান মিশনারি”)
প্রথম বাংলা অভিধান
অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ কেরী সম্পর্কে লিখেছেন এইভাবে:
উইলিয়ম কেরি। স্মরণীয় তিনি বাঙলা গদ্যের ইতিহাসে, অবিস্মরণীয় বাঙলা অভিধানের ইতিকথায়। ফরস্টারের পর দেড় দশকের মধ্যে যখন বেরোয় উইলিয়ম কেরির বিশাল অভিধান, তখন নিশ্চয়ই বাঙলা ভাষা তাঁর দিকে তাকিয়েছিলে। মুগ্ধ, বিস্মিত, কৃতজ্ঞ চোখে। কেরির অভিধানের নাম এ ডিকশনারি অফ দি বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ, ইন হুইচ দি ওয়র্ডস আর ট্রেসড টু দেয়ার অরিজিন, অ্যান্ড দেয়ার ভেরিয়াস মিনিংস গিভেন। এর প্রথম খণ্ড বেরোয় ১৮১৫-তে; …কেরির অভিধান অনেক বেশি সুদৃশ্য ও সুশৃঙ্খল ফরস্টারের অভিধানের চেয়ে। শব্দের পরিমাণও অনেক বেশি, বিচ্যুতিও অনেক কম। তিনি প্রায় স্থির ক’রে ফেলেন অধিকাংশ বাঙলা শব্দের সংস্কৃতানুসারী বানান। সে-কালের প্রধান গদ্য লেখকদের বানানে যে-অস্থিরতা দেখা যায়, তা নেই এ-অভিধানে। কেরি বহু শব্দ নিয়েছেন সংস্কৃত অভিধান থেকে, বহু শব্দ নিয়েছেন বাস্তব জীবন থেকে, এবং নিজে তৈরি করেছেন প্রচুর শব্দ। … কেরির অভিধান বেশ সুস্থির ক’রে দেয় বহু বাঙলা শব্দের রূপ ও বানান; এবং আধুনিক বাঙলা মানভাষার বিকাশে পালন করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কেরি যদি বাঙালি হতেন, তাহলে প্রভাব বিস্তার করতে পারতেন আরো বেশি। মহিমা পেতেন বাঙলা ভাষার প্রধান অভিধানপ্রণেতার। তাঁকে বলতাম বাঙলা অভিধানের জনসন। (কতো নদী সরোবর বা বাঙলা ভাষার জীবনী, হুমায়ূন আজাদ, পৃঃ ৯৭)
কেরীর রচিত বাংলা অভিধান জনপ্রিয়তা পেলেও সেটা প্রথম অভিধান ছিল না; তার আগে আর একজন ঈসায়ী প্রচারক এই কৃতিত্ব অর্জন করেন:
“প্রথম বাংলা অভিধান Vocabulario em Idioma Bengala E Partuguez নামে পর্তুগিজ পাদ্রি মানোএল দা আসসুম্পসাঁউ কর্তৃক সংকলিত হয়।”
(বাংলাপিডিয়া, “অভিধান”)
প্রথম বাংলা জ্ঞানকোষ
“বঙ্গে সর্বপ্রথম জ্ঞানকোষের উদ্যোগ করলেন ফিলিক্স কেরী, উইলিয়ম কেরীর পুত্র। তার বিদ্যাহারবলী (১৮১৯-২১) ছিল ছোটদের তথ্যের বই।” (বাংলাপিডিয়া, প্রধান সম্পাদকের ভূমিকা”)
প্রথম বাংলা পাঠ্যপুস্তক
এই ‘শ্রীরামপুর ত্রয়ী”এর দ্বারা বাংলা ভাষার প্রথম পাঠ্যপুস্তকগুলো রচনা করা হল:
“কেরীর নেতৃত্বে একদল বাঙালি পণ্ডিত বাংলা পাঠ্যপুস্তক রচনা ও বাংলা ভাষা শিক্ষার কাজ শুরু করেন। এভাবে কেরী এবং ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের প্রচেষ্টায় বাংলা ভাষার একটি পরিকল্পিত ধারার প্রবর্তন ঘটে।” (বাংলাপিডিয়া, “বাংলা সাহিত্য”)
অন্য প্রবন্ধে বাংলাপিডিয়া আরও বলে:
“বাংলা ভাষায় অনুবাদ ও প্রথম গ্রন্থ প্রকাশের কৃতিত্বের কারণে তাঁকে ১৮০১ সালে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের বাংলার অধ্যাপক নিযুক্ত করা হয়। একই সঙ্গে তিনি সংস্কৃত ও মারাঠি ভাষাও পড়াতেন। ঐ সময়ে কলেজ পর্যায়ের উপযুক্ত বাংলা পাঠ্যপুস্তকের অভাবে ছিল। এ বিষয়টি অনুভব করে কেরী বাংলা ব্যাকরণ ও কথোপকথন (১৮০১) প্রকাশ করেন। ১৮১২ সালে প্রকাশিত হয় তার ইতিহাসমালা। তার রচিত অন্যান্য গ্রন্থ হচ্ছেঃ নিউ টেস্টামেন্ট, ওল্ড টেস্টামেন্ট ও বাংলা-ইংরেজি অভিধান।” (বাংলাপিডিয়া, “উইলিয়ম কেরী”)
শ্রীরামপুর মিশন প্রেস
উইলিয়ম কেরী ১৮০০ সালে শ্রীরামপুর মিশন প্রেস স্থাপন করে বাংলা ভাষার জন্য তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তির স্বাক্ষর রাখেন।
“…শ্রীরামপুর প্রাচ্যে মুদ্রণ শিল্পে গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা করে। . . . ১৮০০-১৮৩২ সালের মধ্যে শ্রীরামপুর প্রেস থেকে ৪৫টি ভাষায় ২,১২,০০০ বই ছাপা হয়। সমকালীন বিশ্বে খুব কমসংখ্যক প্রেসই এ ধরনের কৃতিত্বের অধিকারী ছিল।” (বাংলাপিডিয়া, “শ্রীরামপুর মিশন প্রেস”)
শ্রীরামপুর মিশন মুদ্রণ ও প্রকাশনা ক্ষেত্রেও পথিকৃৎ ছিল। কেরী ছিলেন বিশিষ্ট ভাষাবিদ। তাঁর নির্দেশনায় শ্রীরামপুর মিশন প্রেস পূর্ণাঙ্গ বাইবেলের বাংলা, অহমীয়, উড়িয়া, হিন্দি, মারাঠি ও সংস্কৃত অনুবাদ ছাপায়। বাইবেলের অনুবাদ ছাড়াও ব্যাপ্টিস্টগণ ও তাঁদের ভারতীয় সহযোগীবৃন্দ (যেমন, রামরাম বসু ও মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার) রামায়ণ ও অন্যান্য ভারতীয় প্রাচীন সাহিত্যের অংশ বিশেষ অনুবাদ করেন। তাঁরা বহুসংখ্যক গবেষণামূলক প্রবন্ধ অথবা প্রচারণমূলক পুস্তিকা (১৮২৯ সাল নাগাদ প্রায় ৩৩,০৫০টি) অনুবাদ, মুদ্রণ ও বিতরণ করেন। এ দৃষ্টান্ত কলকাতা স্কুল বুক সোসাইটিকে (১৯১৭) ১৮২১ সাল নাগাদ বাংলায় পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ করতে অনুপ্রাণিত করে। এ প্রকাশনাসমূহ সন্দেহাতীতভাবে বাংলা গদ্য সাহিত্যের অগ্রগতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। (বাংলাপিডিয়া, “খ্রিষ্টান মিশনারি”)
বাইবেলের বাংলা অনুবাদ, হিতোপদেশ ও কথোপকথন নামে তিনখানা পুস্তক ছাপা হয় মিশন প্রেস থেকে। কেরীর মুন্সী রামরাম বসু প্রকাশ করেন প্রতিপাদিত্য চরিত, রামায়ণ ও মহাভারতের বাংলা অনুবাদ।।… মিশনারিদের আর একটি অবদান হলো শ্রিরামপুরে ভারতে প্রথম বাষ্পীয় কাগজ কল স্থাপন করা। ১৮০১-১৮৩২ সালের মধ্যে শ্রীরামপুর প্রেস থেকে ৪০টি ভাষায় মোট ২,১২,০০০ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এই সকল উন্নয়নে শ্রীরামপুরের স্থানীয় জনসাধারণ প্রায়শই নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করতেন। মিশনারিদের জনশিক্ষা বিস্তার, প্রকাশনা সংক্রান্ত কাজকর্ম বা সমাজ সংস্কারমূলক যেকোন ধরনের কাজে শ্রীরামপুরের অভিজাত-অনভিজাত নির্বিশেষে প্রায় সকলেই দর্শকের ভূমিকা পালন করতেন। (বাংলাপিডিয়া, “শ্রীরামপুর”)
সততা, নির্ভরশীলতা, ব্যয়ে স্বল্পতা, উন্নত মুদ্রণ প্রভৃতির জন্য অল্প সময়ের মধ্যে শ্রীরামপুরের মুদ্রণ শিল্প সারা পৃথিবীতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু ইংরেজ কোম্পানি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে এরূপ উন্নত মুদ্রণশালার অস্তিত্ব পছন্দ করে নি। তারা প্রেসটি বন্ধ করে দিতে বারবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু দেন্মার্ক সরকারের জন্য তা সম্ভব হয় নি। (বাংলাপিডিয়া, “শ্রীরামপুর মিশন প্রেস”)
সেই মুদ্রণ শিল্প এশিয়ার সবচেয়ে বড় ছাপাখানার পদ পাওয়া ছাড়া বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সবচেয়ে বড় ছাপাখানা ছিল, এবং শ্রীরামপুর মিশন প্রেসে চল্লিশটি ভাষায় দুই লক্ষ বই প্রকাশ হয়েছে। বাংলাপিডিয়া এভাবে বলেন:
“শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্র, সমাজ সংস্কার প্রভৃতি ক্ষেত্রে মিশন প্রত্যক্ষভাবে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করে। এভাবে ধীরে ধীরে দেশে নবজাগরণের পথও প্রস্তুত হয়। মিশন এ সময় পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের বহু স্থানে তাদের শাখা স্থাপন করে।” (বাংলাপিডিয়া, “শ্রীরামপুর মিশন”)
বাংলা গদ্য সাহিত্য প্রসারেও মিশন পথিকৃতের ভূমিকা গ্রহণ করে।” (বাংলাপিডিয়া, “শ্রীরামপুর মিশন”)
শ্রীরামপুর মিশনের গনশিক্ষা কার্যক্রম
বাংলা-মাধ্যমে শিক্ষা এবং সাক্ষরতায় কেরী ছিলেন প্রবর্তক বা অগ্রদূত। কেরীর আগমণের পূর্বে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা উচ্চসমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এবং সেটা ছিল প্রধানত লম্বা লম্বা আরবি বা সংস্কৃত ভাষায় কবিতা বা শাস্ত্র মুখস্থ করা। জনসাধারণ সাক্ষরতার শতকরা হার অতিমাত্রায় কম ছিল, এবং তখন বাংলা ভাষায় নয় কিন্তু সংস্কৃত বা আরবি ভাষায়। রামমোহন রয়ের মত পরের পণ্ডিতগণ যখন ইংরেজিকে উচ্চশিক্ষার মাধ্যম আনতে চাচ্ছিল, কেরী জোর করে বলতেন যে বাংলা ভাষাকে বঙ্গের উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হওয়া উচিত।
যে যুগে নারীদের অজ্ঞ ও আলাদা করে রাখা তাদের সতীত্বের একটি প্রয়োজনীয় অংশ বলে সমাজ মনে করত। সেই সময় শ্রীরামপুর মিশন সেই অঞ্চলের প্রথম মহিলা বিদ্যালয় স্থাপন করে।
বিশাল মঙ্গলবাদী, ভারতের একজন কেরী-বিশেষজ্ঞ তাঁর “The Legacy of William Carey” [“উইলিয়ম কেরীর অবদান”] গ্রন্থে লিখেছেন:
“ভারতের সব জাত ও শ্রেণীর ছাত্রের জন্যে কেরী ডজন-ডজন স্কুল স্থাপন করেছেন এবং এশিয়ার সর্বপ্রথম ডিগ্রি কলেজ তিনি শুরু করেছেন শ্রীরামপুরে। তিনি ভারতীয় মনকে উন্নতি করতে ও কুসংস্কারের অন্ধকার থেক মুক্ত করতে চাইতেন। প্রায় তিন হাজার বছর ধরে ভারতের ধর্মীয় সংস্কৃতি অধিকাংশ ভারতীয় মানুষদের তথ্যের স্বাধীন প্রবেশাধিকার থেক নিরোধ করেছেন; এবং হিন্দু, মুঘল ও ইংরেজ নেতারা এই জনগণকে অজ্ঞতার বন্দীদশায় রাখা উচ্চশ্রেণীর কৌশলের পথে থাকল। ধর্মযাজকদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে কেরী মহৎ আত্মিক শক্তি দেখাল, যারা নিজ সুবিধার জন্যে জনগণকে সত্যকে জানার স্বাধীনতা ও ক্ষমতা থেক বিরত রাখতেন।”
বা বাংলাপিডিয়ার অন্য এক প্রবন্ধে:
“শ্রীরামপুরের পার্শ্ববর্তী বিস্তৃর্ণ অঞ্চলে শতাধিক মিশনারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন। হ্যানা মার্শম্যান স্থাপন করেন প্রথম বালিকা বিদ্যালয়। কিন্তু উইলিয়ম কেরী ১৮০০ সালে শ্রীরামপুর মিশন প্রেস স্থাপন করে তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তির স্বাক্ষর রাখেন, যেখানে পঞ্চানন কর্মকারের তৈরি কাঠের হরফ ব্যবহৃত হতো। ১৮১৮ সালে কেরী ও তাঁর দুই সহকর্মী তাঁদের সারা জীবনের সঞ্চিত অর্থ ব্যয়ে নির্মাণ করেন শ্রীরামপুর কলেজ। এটি এশিয়ার মধ্যে প্রথম ডিগ্রি কলেজ। কেরী বাংলা গদ্যের জনক হিসেবে লাভ করেন। (বাংলাপিডিয়া, “শ্রীরামপুর”)
প্রথম সময়কাল-অর্থাৎ কেরীর আমলে – প্রোটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায়ভুক্ত করার ব্যাপারে প্রস্তুতিমূলক কাজ হিসেবে প্রধান গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে দেশীয় ভাষা ও সাহিত্যের অগ্রগতিসাধন এবং শিক্ষা বিস্তারের ওপর। (বাংলাপিডিয়া, “খ্রিষ্টান মিশনারি”)
প্রাথমিকভাবে মাতৃভাষার প্রতি সহানুভুতিশীল হলেও শ্রীরামপুর ত্রয়ী গ্রাম্য পাঠশালার ওপর ভিত্তি করে বিরাজমান শিক্ষা ব্যবস্থায় খ্রিষ্টান ধারণাসমূহ অন্তর্ভুক্ত করতে চেষ্টা করেছিলেন। সাধারণ জনগণের নিকট শিক্ষা পৌঁছে দিতে ‘সরদার-পড়য়া’র মতো দেশী ব্যবস্থা গ্রহণ করে কেরী জনগণের শিক্ষার একটি কার্যক্রম গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।
১৮৩০-এর দশকে ইংরেজদের দ্বারা প্রচলিত রীতি হিসেবে চালু করা শিক্ষার ব্যাপারে ‘নিচ দিকে উপচে পড়া তত্ত্বে’ কেরীর কোন আস্থা ছিল না এবং তিনি শিক্ষা ব্যবস্থাকে নিচ দিক থেকে গড়ে উপরের দিকে তুলতে চেয়েছিলেন। এ উদ্দেশ্য নিয়ে তাঁর সহযোগী জে. মার্শম্যান ১৮১৬ সালে গ্রামাঞ্চলে মাতৃভাষা শিক্ষাদানকারী স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য ‘স্থানীয় স্কুল সম্বন্ধে আভাস’ নামে পরিচিত একটি সম্পূর্ণ কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেন। এতে জোর দেওয়া হয় যে, শিক্ষার মাধ্যম হওয়া উচিত জনগণের মাতৃভাষা। গ্রামের স্কুলসমূহের উচিত পাটিগণিত, প্রাথমিক বিজ্ঞান, ইতিহাস ও ভূগোলের মোটামুটি প্রধান অংশসমূহ, প্রাকৃতিক দর্শন, ধর্মশাস্ত্র ও নীতিশাস্ত্রকে অন্তর্ভুক্ত করে ‘উন্নত’ পাঠক্রম অনুসরণ করা। এ কর্মপরিকল্পনা আপাতভাবে সাফল্যমণ্ডিত হয়; ১৮১৮ সাল নাগাদ ৬,৭০৩ জন ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে ১০৩টি প্রাথমিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। ব্যাপ্টিস্টদের ‘নন্কন্ফর্মিস্ট নীতি-বোধ’ প্রারম্ভে তাঁদেরকে কোনপ্রকার রাষ্ট্রীয় সাহায্য গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখে।
একজন সত্যিকার ‘খ্রিষ্টান প্রাচ্যবিদ’ হিসেবে কেরী তাঁর শিক্ষা পরিকল্পনায় সনাতন ও মাতৃভাষা সংক্রান্ত ধারণাসমূহকে সংযুক্ত করেছিলেন। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ এর (১৮০০) একজন অধ্যাপক এবং এশিয়াটিক সোসাইটির (১৮০৬) একজন সংস্কৃতের অধ্যাপক হিসেবে তিনি প্রাচ্যদেশীয় সনাতন বিদ্যাসমূহের অধ্যায়নকে উৎসাহিত করেছিলেন, কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ভারত ও পাশ্চাত্যের মধ্যে সাংস্কৃতিক সংযোগ স্থাপনের পথ সহজ করে তোলার জন্য বাইবেলকে সংস্কৃতি ও ফারসি ভাষায় অনুবাদ করা উচিত। যদিও মুখ্যত তিনি মাতৃভাষায় জ্ঞান চর্চার একজন চার্টার অ্যাক্ট পাসের পর ইউরোপীয় বৈজ্ঞানিক শিক্ষা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে তিনি সরকারি অনুদানের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তার প্রণীত ভারতের দেশীয় অধিবাসীদের ইউরোপীয় বিজ্ঞান শিক্ষাদানের পরিকল্পনাকে (জুন, ১৮১৪) ভারতে প্রথম সর্বাত্মক শিক্ষাদানের প্রোগ্রাম হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। ১৮১৮ সালে শ্রীরামপুর ত্রয়ী এশীয় যুবাদের প্রাচ্যদেশীয় সাহিত্য ও ইউরোপীয় বিজ্ঞান সম্পর্কে পূর্ণ শিক্ষা দান করতে শ্রীরামপুর কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। (বাংলাপিডিয়া, “খ্রিষ্টান মিশনারি”)
শ্রীরামপুরের এই পাদ্রী ত্রয়ী খ্রিষ্টধর্ম প্রচারে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। তাঁরা প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন, যার পাঠ্যসূচিতে আধুনিক বিজ্ঞান, ভূগোল ও ইতিহাসের প্রাথমিক পাঠ অন্তর্ভুক্ত হয়। তাঁরা এসব স্কুলের জন্য বাংলায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও নিজেদের প্রতিষ্ঠিত প্রেস থেকে সেসব প্রকাশ করেন। ১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দে কলিকাতা স্কুল-বুক সোসাইটি প্রতিষ্ঠায় তাঁরা উদ্যোক্তাদের সহযোগিতা করেন। এই সোসাইটি প্রাথমিক স্কুলগুলিতে ব্যবহারের জন্য উপর্যুক্ত গ্রন্থসমূহের হাজার হাজার কপি মুদ্রণ করে। … পাঠ্যপুস্তক ছাড়া শ্রীরামপুরের ব্যাপ্টিস্টরা বাংলা ভাষায় উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। (বাংলাপিডিয়া, “খ্রিষ্টধর্ম”)
সামাজিক ব্যাধি
“শ্রীরামপুরের যাজকরা সমকালীন হিন্দুসমাজে প্রচলিত অমানবিক আচরণ, যেমন সাগরদ্বীপে শিশুহত্যা, সতীদাহ ইত্যাদির বিরুদ্ধে জনমত গঠন ও সরকারকে প্রভাবিত করতে চেয়েছিলেন; এসবের ওপর তাঁরা একটি গবেষণাও চালিয়েছিলেন।” (বাংলাপিডিয়া, “খ্রিষ্টধর্ম”)
শ্রীরামপুর ত্রয়ী কিছু হিন্দু সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও আচারানুষ্ঠান, যেমন জাতিভেদ প্রথা, সতী, শিশুহত্যা, অন্তর্জলি (রুগ্ন ব্যক্তিদের নদীর তীরে অনাবৃত অবস্থায় ফেলে রাখা), ইত্যাদির সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে জনমত গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। ১৮০৪ থেকে ১৮২৯ সালের মধ্যবর্তী সময়ে এ রকম কিছু আচারকে নিষিদ্ধ আইন পাসে তাঁরা সহায়ক ছিলেন। তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে, শুধু খ্রিষ্টানদের সত্যের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা শিক্ষাই এ সামাজিক ব্যাধিসমূহ দূর করতে পারে। (বাংলাপিডিয়া, “খ্রিষ্টান মিশনারি”)
শ্রীরামপুর মিশনের অন্যান্য তাৎপর্যপূর্ণ অবদান
বাংলা ভাষায় কিতাবুল মোকাদ্দস অনুবাদ করার পরে কেরী তেমনভাবে মূল হিব্রু ও গ্রিক পান্ডুলিপি থেকে ভারতবর্ষের অন্যান্য অনেক ভাষায় তিনিই সর্বপ্রথম কিতাবুল মোকাদ্দস অনুবাদ করেছেন। ভারতবর্ষের মাতৃভাষা ও উপভাষার প্রথম বিস্তৃত জরিপ-মানচিত্র করেছিলেন। কেরী সবার আগে ভারতের মহৎ সাহিত্য গ্রন্থাদি ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ ও প্রকাশ করেছেন, যেমন রামায়ণ ও সংখ্যদর্শন শাস্ত্র। তিনিই অবশ্য পূর্ণ-আকারে প্রথম সংস্কৃত অভিধান বা শব্দকোষ লিখেছিলেন।
ঈসা মসীহ্র আদর্শ অনুসারে কেরী বিশ্বাস করতেন যে আল্লাহ্র দৃষ্টিতে সমস্ত জাতির ভাষা এবাদত ও কিতাব পড়ার যোগ্য। এই ক্ষেত্রে তিনি পরবর্তি প্রগতিশীল পণ্ডিতদের চেয়ে প্রাগ্রসর ছিলেন, যেমন রামমহোন রয় শুধু সংস্কৃত, ফারসি ও ইংরেজি উপাসনায় গ্রহণযোগ্য বাষা হিসাবে বিশ্বাস করতেন। ইতোমধ্যে রবীন্দ্রনাথেরও অনেক পূর্বে কেরী বাংলা ভাষায় স্রষ্টার উপাসনার জন্য নিজে একশ’রও বেশি সঙ্গীত রচনা করেন।
তিনি ভারতীয় অন্যান্য ভাষায়ও বাইবেলের অনুবাদ ও অভিধান প্রকাশ করেন। ১৮২৯ সালে তিনি সতীদাহ নিবারক আইন অনুবাদ করেন। কেরী ভারতীয় কৃষি, ভূবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা ও প্রাণিবিদ্যা সম্বন্ধেও প্রচুর গবেষণা করেন। ১৮২৩ সালে তিনি ভারতে ‘এগ্রি-হর্টিকালচার সোসাইটি’ স্থাপন করেন। তিনি ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া নামে একটি ইংগ্রেজি পত্রিকাও প্রকাশ করেন। আধুনিক যুগের শুরুতে বাংলা মুদ্রণ যন্ত্রের প্রচলন, বাংলা ভাষার ব্যাকারণ ও গদ্যগ্রন্থ রচনা এবগ্ন সেগুলি প্রকাশের জন্য একজন বিদেশী হয়েও উইলিয়ম কেরী বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে একটি বিশষ স্থান দখল করে আছেন।” (বাংলাপিডিয়া, “উইলিয়ম কেরী”)
কেরী শ্রীরামপুরে উদ্ভিদবিদ্যা ও কৃষিবিদ্যায়ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তিনি সেখানে বাগান তৈরি করেন এবং বিদেশ থেক বীজ এনে নতুন জলবায়ু গ্রহণে সক্ষম বৃক্ষ উৎপাদন করেন। ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এগ্রি-হর্টিকালচার সোসাইটি অব ইন্ডিয়া স্থাপনেও নেতৃত্ব দেন। (বাংলাপিডিয়া, “খ্রিষ্টধর্ম”)
“…মিশনারিদের আর একটি অবদান হলো শ্রিরামপুরে ভারতে প্রথম বাষ্পীয় কাগজ কল স্থাপন করা। ১৮০১-১৮৩২ সালের মধ্যে শ্রীরামপুর প্রেস থেকে ৪০টি ভাষায় মোট ২,১২,০০০ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এই সকল উন্নয়নে শ্রীরামপুরের স্থানীয় জনসাধারণ প্রায়শই নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করতেন। মিশনারিদের জনশিক্ষা বিস্তার, প্রকাশনা সংক্রান্ত কাজকর্ম বা সমাজ সংস্কারমূলক যেকোন ধরনের কাজে শ্রীরামপুরের অভিজাত-অনভিজাত নির্বিশেষে প্রায় সকলেই দর্শকের ভূমিকা পালন করতেন।” (বাংলাপিডিয়া, “শ্রীরামপুর”)
কেরী কেন প্রথম ছিলেন?
যখন বঙ্গের অধিকাংশ ধর্মীয় প্রচারক সংস্কৃত ও আরবি ভাষার গুণগান গাইতেন, এই কিতাবুল মোকাদ্দসের মূল হিব্রু ও গ্রিক ভাষার বিশেষজ্ঞ তার সমস্ত জীবন ব্যয় করলেন বাংলা ভাষার উৎকর্ষে। একজন ধর্মপ্রচারক কেন এমন কাজ করতে পারতেন? ইংরেজ কোম্পানির সহায়তা বা সমর্থন পাওয়ার জন্য তিনি প্রথম ছিলেন না। আমরা এর মধ্যে দেখতে পেরেছি যে ইংরেজ কোম্পানি কেরীর কাজের বিরুদ্ধে দাঁরালো এবং বারবার তা বন্ধ করতে চেষ্টা করতেন কারণ তারা ভয় করতেন যে গনশিক্ষা ও অক্ষরতার ফলে তাদের আর্থিক স্বার্থ বা কার্যক্রমের ক্ষতি হতে পারে।
কেহ বলতে পারে যে কেরীর কাছে বেশি অর্থসম্পদ থাকার কারণে তিনি এসব প্রথম করতে পেরেছেন। কিন্তু তা নয়:
“এই মিশন ছিল স্বনির্ভরশীল। মার্শম্যান বিদ্যালয় থেকে, ওয়ার্ড প্রেস থেকে এবং কেরী ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ এ অধ্যাপনা করে নিজেদের ভরণপোষণ ও মিশনের কাজ চালাতেন।” (বাংলাপিডিয়া, “শ্রীরামপুর মিশন”)
আসলে কেরী কলকাতার অন্যান্য বাঙালি ব্রাহ্মণ পরিবারের চেয়ে গরিব ছিলেন। আগে যেভাবে উদৃতি করা আছে, কেরীর দল তাদের নিজ শ্রমের শেষ পয়সা ব্যয় করেছেন অক্ষরতার উদ্যোগে। সেই সময়ে কলকাতায় অনেক বিলেতি-শিক্ষাসম্পন্ন ভদ্রলোক ছিল যারা বাংলা ভাষার জন্য কোন উদ্যোগ নেয় নি।
কেরীর অপূর্ব উদ্যোগের বাকি একমাত্র ব্যাখ্যা হচ্ছে যে তিনি মাতৃভাষা সম্মান দেওয়ার একটি অন্যন্য চিন্তাধারা পালন করতেন – ঈসা মসীহ্র শিক্ষার অনুসারে। ঈসার অনুসরণ করে কেরীর একটি লক্ষণীয় দর্শন ছিল প্রত্যেকটি জাতি আল্লাহ্র পবিত্র কালাম নিজ নিজ মাতৃভাষায় পড়ে এবং এবাদত করার সুযোগ দিতে। তিনি জানতেন যে জনগণের মুক্তি কোন অজানা ভাষায় শাস্ত্র মন্ত্রের মত সঠিক উচ্চারণ করার মাধ্যমে আসবে না বরং আল্লাহ্র চিরন্তন কালামের অর্থ বুঝা এবং তার অনুসারে আমাদের চিন্তা ও চরিত্র গঠন করা। যদিও তিনি শিক্ষায়, কৃষিবিজ্ঞান, উদ্যানবিদ্যা, ভূতত্ত্ব, প্রাণিবিজ্ঞান ও উদ্ভিদবিজ্ঞানে অনেক বিরাট ভূমিকা পালন করেন, তিনি সবসময় জানতেন যে জনগণের মুক্তি আনার প্রথম কাজ ছিল আল্লাহ্র কালাম তাদের মাতৃভাষায় অনুবাদ করা।
কেরী বঙ্গদেশে যা করেছেন তা পৃথিবীর অনেক প্রান্তে এমনভাবে হয়েছে। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের লামিন সান্নেহ্ নামক একজন সম্মানিত আফ্রিকান ইতিহাসের অধ্যাপক তার Translating the Message বইয়েতে দেখিয়েছে যে উপনিবেশিত জাতিদের মাতৃভাষা শক্তিশালী করে তলার প্রধান উৎস হচ্ছে কিতাবুল মোকাদ্দসের অনুবাদ। ঈসা মসীহ্র হাজার হাজার অনুসারী কিতাবের মূল গ্রিক ও হিব্রু ভাষার পাণ্ডুলিপি থেকে প্রায় সমস্ত ভাষায় অনুবাদের উদ্যোগ নিয়েছেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল মানুষদের আল্লাহ্র পবিত্র কালাম বোঝানো যাতে তারা নিজেকে অন্ধকার থেক মুক্ত পেয়ে আল্লাহ্র কাছে যেতে পারে। এই অধিকাংশ ভাষা হল পরিভূত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যারা বিদেশী শাসনের অধীনে ছিল। কেরীর দলের মত তারা সাধারণত বিপক্ষতা এবং বিরোধিতা পেত উপনিবেশি নেতাদের কাছে যারা এদের কার্যক্রমের ফল ভয় করত। যখন এইভাবে কিতাবের অনুবাদ হয়, একটি বর্ণমালা আবিষ্কার হয় এবং সাধারণ মানুষ নিজ ভাষায় লেখাপড়া শেখে, তারা ক্ষমতা পায় মিক্তি পেয়ে নিজেকে নিজ ভাষায় নিয়ন্ত্রন করতে।
এখন শত বছরের বিদেশী ভাষার কর্তৃত্বের পর, আমাদের পিতারা সর্বশেষে বিদেশী ভাষার প্রশাসন তাড়িয়ে দিয়েছি। কিন্তু নিজেকে আবার জিজ্ঞাসা করতে হবে; আমরা কি তাদের সেই মাতৃভাষার জন্য প্রাণ-উৎসর্গের সম্মান দিচ্ছি যদি আমরা মনে করি যে বাংলা ভাষা এবাদত এবং কিতাব পড়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য? মাতৃভাষার সম্পর্কে আল্লাহ্র চিন্তা কি? বাংলা ভাষা কি শুধু একটি নিম্ন ভাঙ্গা ভাষা যেটা এবাদতে অযোগ্য? না কি সমস্ত জাতির অন্তরের ভাষা আল্লাহ্র চোখে সমান এবং এবাদতে সমানভাবে যোগ্য? আমার আশায় এই সর্বপ্রথম বাংলা ভাষা আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আপনাকে মাতৃভাষা সম্মান ও উৎকর্ষ করার উৎসাহ দিয়েছেন।