সংক্ষিপ্ত উত্তর:
কোন ঈসায়ী ইচ্ছা করলে ইব্রাহিম নবির ঈমানের বিষয়টিকে স্মরণ করে কোরবানি দিতে পারে; কিন্তু ঈসায়ীদের ক্ষেত্রে হজরত ইব্রাহিমের কোরবানির বাধ্যতামূলক নয়।
ব্যাখ্যামূলক উত্তর:
হজরত ইবরাহিমের কোরবানি ছিল তাঁর ব্যক্তিগত ঈমানের পরীক্ষা। সেই পরীক্ষায় ইবরাহিম উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। হজরত ইবরাহিম কখনও সেই কোরবানি পালনের জন্য কোথাও কোন নির্দেশ দেননি। আজ তাঁর সেই মহা ঘটনাকে স্মরণ করার জন্য কোরবানি দেয়া হয়। ইবরাহিমের কোরবানি একটি ঐচ্ছিক বিষয়। যার অর্থনৈতিক সামর্থ্য আছে তিনি সেই কোরবানি দিতে পারেন। মূলত ধনী লোকেরাই কোরবানি দেন। কোরবান শব্দের অর্থ উৎসর্গ। কোন ধর্মীয় পর্ব বা উৎসর্গ ধনী-গরিব নির্বিশেষে হওয়া উচিত। হজরত ইব্রাহিমের কোরবানি ছিল পোড়ানো কোরবানি। তাওরাত কিতাবের নিয়ম অনুযায়ী (লেবীয় ১ অধ্যায়) কোরবানির পশুকে জবাই করে কোরবান গাহের উপর সম্পূর্ণ পুড়িয়ে দেয়া হতো। ইব্রাহিম তার পুত্রকে বেঁধে জ্বালানি কাঠ সাজিয়ে কোরবানগাহের উপর রেখেছিলেন (পয়দায়েশ ২২ অধ্যায়)। কিন্তু বর্তমানে ভিন্ন উপায়ে কোরবানি দেয়া হয়। অর্থাৎ এখন যে কোরবানি দেয়া হয়, তা স্মরণাত্মক কোরবানি। আল্লাহর উদ্দেশ্যে পশু কোরবানি দিয়ে তা দরিদ্রদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া হয়। সারাবছর যারা মাংস খাওয়া থেকে বঞ্চিত থাকে, তারা এই সময় মাংসের স্বাদ পায়। তবে বাস্তবতা হলো, কোরবানির পশুর মাংস বেশির ভাগই কোরবানি দাতারা নিজেরাই ভোগ করে; আর অবশিষ্টাংশ দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করেন।
বার্ষিক কোরবানির উৎপত্তির ইতিহাস একদিক থেকে খুবই মজার অপরদিক থেকে খুবই বেদনাদায়ক। হজরত ইবরাহিমের অনেক পরে বনিইসরাইলরা ৪৩০ বছর যাবত মিসরে বন্দি ছিল। সেখানে তারা স্বৈরশাসকের নিয়ন্ত্রণে হাজারো দুঃখকষ্ট ভোগ করতো। তাদের দিয়ে অমানুষিক পরিশ্রমই শুধু নয়, তাদের ক্রীতদাস হিসাবে ব্যবহার করা হতো। একসময় হজরত মুসার নেতৃত্বে আল্লাহ তাদের উদ্ধারের ব্যবস্থা করলেন। যেদিন তারা মিসর দেশ থেকে উদ্ধার পাবে, সেদিন আল্লাহ তাদের এক অদ্ভুত আদেশ দিয়েছিলেন। তাদের বলেছিলেন, যেন তারা নির্দোষ পশু জবাই করে, সেই পশুর রক্ত তাদের ঘরের চৌকাঠে লাগিয়ে রাখে। বনিইসরাইলরা তা-ই করেছিলেন। সেই দিন রাতে আল্লাহর ফেরেশতা মিসর দেশের উপর দিয়ে গিয়েছিলেন। যে যে ঘরের দরজায় রক্ত ছিল সেই ঘরগুলো ছাড়া মিসরিয়দের সব ঘরের ১ম সন্তান এবং গরু-বাছুরের ১ম সন্তানও মারা গিয়েছিল। এমনকি ফেরাউনের ঘরেও সেই মৃত্যু হানা দিয়েছিল। ফলে তারা বনি-ইসরাইলকে মিসর থেকে ছেড়ে দিয়েছিল। বনিইসরাইল জাতি এই ঘটনাকে স্মরণ করার জন্য অর্থাৎ তাদের উদ্ধারের দিনকে স্মরণ করার জন্য বার্ষিক কোরবানি দিতো। এইভাবে তাদের দ্বারাই তাদের মধ্যে বার্ষিক কোরবানির প্রচলন হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে অন্যান্য ধর্মের লোকও বার্ষিক কোরবানি দিতে শুরু করে।
বোঝা যায়, হজরত ইবরাহিমের অনেক পরে বনিইসরাইল জাতির জন্য এই কোরবানি আবশ্যকীয় হয়। তবে কোরবানি উৎসবের আসল অর্থ তা নয়। এরপর এই কোরবানি তাদের গুনাহ মাফের কাফফারা হিসাবে দেয়ার জন্য আল্লাহর কাছ থেকে নির্দেশ আসে এবং এটাকে ফরজ করে দেয়া হয়। অর্থাৎ যে ব্যক্তি গুনাহ করে তাকেই কোরবানি দিতে হবে। যেহেতু গুনাহ ছাড়া মানুষ নেই সেহেতু প্রত্যেককেই প্রতিবছর একবার তো বটে, বরং সারা বছরই তাদের কোন না কোন কোরবানি দিতে হতো। জানা অজানা সব গুনাহ থেকে মাফ পাবার ব্যবস্থা হিসাবে আল্লাহ তাদের এই কোরবানির ব্যবস্থা দিয়েছিলেন। বছরে একবার তারা মহাইমামের মাধ্যমে মহাকোরবানি দিতো। সারা বছর আরো ছোট ছোট অনেক ধরনের কোরবানি দিতো।
ঈসায়ীরা কেন বার্ষিক কোরবানি দেয় না? এই প্রশ্নের প্রেক্ষাপট বড় হলেও তার উত্তর খুবই সহজ। সেই উত্তর হলো, ঈসায়ীরা বিশ্বাস করে যে, মানব জাতির গুনাহর জন্য হজরত ঈসা নিজের জীবন কাফফারা দিয়েছেন। তারা যেহেতু সেই কাফফারায় বিশ্বাসী সেহেতু তাদের জন্য সেই বার্ষিক কোরবানির আর প্রয়োজন নেই। কিতাবে লেখা আছে, “বর্তমানকালের জন্য এটা একটা চিহ্ন যা আমাদের বলে দিচ্ছে যে, কোরবানি দেওয়া পশু এবং অন্যান্য জিনিস এবাদতকারীর বিবেককে পরিষ্কার করতে পারে না। সেগুলো কেবল শরীরের ব্যাপার, অর্থাৎ খাওয়া-দাওয়া ও শরিয়ত মতো পাক-সাফ হবার ব্যাপারমাত্র। কিন্তু মসীহ এসেছিলেন ভবিষ্যতের সব উন্নতির বিষয়ে মহাইমাম হয়ে। আরো মহৎ ও আরো ভালো এবাদত-তাম্বুতেই আল্লাহর এবাদত-কাজ করবার জন্য তিনি এসেছিলেন” (ইঞ্জিল শরিফ, ইবরানি ৯:৯-১১ আয়াত) । নবিরা যেমন তাঁর এই জীবনদায়ী কাফফারা সম্পর্কে ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন, তেমনি তিনি নিজেও বলেছেন, “মনে রেখো, ইবনে-আদম সেবা পেতে আসেননি বরং সেবা করতে এসেছেন এবং অনেক লোকের মুক্তির মূল্য হিসাবে তাদের প্রাণের পরিবর্তে নিজের প্রাণ দিতে এসেছেন” (ইঞ্জিল শরিফ, মথি ২০:২৮)। তিনি আরো বলেন, “… আমি এসেছি যেন তারা জীবন পায় আর সেই জীবন যেন পরিপূর্ণ হয়” (ইঞ্জিল শরিফ, ইউহোন্না ১০:১০)। অতএব, ঈসায়ীরা ঈসা মসীহের কাফফারায় বিশ্বাসী বলে তাদের পশু কোরবানির প্রয়োজন নেই। কিতাব অনুযায়ী মানুষের গুনাহ মাফের জন্য মসীহই চূড়ান্ত এবং সর্বোত্তম কোরবানি।