ইসলাম ও মসীহী মতে পাপ ও পাপের ক্ষমা

লেখক: ইস্কান্দার জাদীদ

অনুবাদ: মসীহী জামাত

প্রকাশক: মসীহী জামাত


সূচিপত্র

ইসলামের দৃষ্টিতে পাপ
মসীহী মতে পাপ
জগতে পাপের আগমন
ইসলামের দৃষ্টিতে কাফফারা
ধার্মিকতা পাপ মোচন করে
ইসলামের দৃষ্টিতে ক্ষমা
মসীহীয়াতে কাফফারা
কাফফারার মাধ্যমে পাপক্ষয়ের প্রয়োজনের পক্ষে যুক্তিসমূহ
উসংহার


ইসলামের দৃষ্টিতে পাপ

কোরান শরীফে পাপ সম্পর্কে বহু উক্তি রয়েছে। তার মধ্যে প্রধান কয়েকটি নিম্নরূপ:

১। ذَنْبِ আয-যাম্ব্ (দোষ, ত্রুটি, অপরাধ, অপকর্ম)। এই বিষয়ের উপর কোরান শরীফে ৩৯টি আয়াত পাওয়া যায়। তার মধ্যে নিচের উক্তিটিকে প্রতিনিধিস্থানীয় বলে মনে করা যায়:

إِنَّا فَتَحْنَا لَكَ فَتْحًا مُّبِينًا لِيَغْفِرَ لَكَ اللَّهُ مَا تَقَدَّمَ مِن ذَنبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ وَيُتِمَّ نِعْمَتَهُ عَلَيْكَ وَيَهْدِيَكَ صِرَاطًا مُّسْتَقِيمًا

“আল্লাহ্ তোমার (মুহম্মদের) জন্য অবধারিত করিয়াছেন নিশ্চিত বিজয়। ইহা এই জন্য যে তিনি তোমার অতীত ও ভবিষ্যৎ ত্রুটি সমূহ (আয্-যাম্ব্)মার্জনা করিবেন……।”

সূরা ফাতহ ১-২

২। الْفَوَاحِشَ আল্-ফাহ্শ্ (অশ্লীলতা, ব্যভিচার)।-বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে ব্যভিচারজনিত পাপ বোঝাবার জন্য শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে এবং কোরান শরীফে তা হারাম ঘোষিত হয়েছে।:

قُلْ تَعَالَوْاْ أَتْلُ مَا حَرَّمَ رَبُّكُمْ عَلَيْكُمْ أَلاَّ تُشْرِكُواْ بِهِ شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَلاَ تَقْتُلُواْ أَوْلاَدَكُم مِّنْ إمْلاَقٍ نَّحْنُ نَرْزُقُكُمْ وَإِيَّاهُمْ وَلاَ تَقْرَبُواْ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَلاَ تَقْتُلُواْ النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللّهُ إِلاَّ بِالْحَقِّ ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ

“…..প্রকাশ্যে হউক কিংবা গোপনে হউক, অশ্লীল আচারণের (মূলে আছে বহুবচনে:‘ফাওয়াহিশ’)নিকটেও যাইবে না;…..”

সূরা আন’আম ৬:১৫১

৩। الوِزْر আল্-ভিয্র্ (ভারী বোঝা হিসাবে পাপ,দায়)। কোরান শরীফে রয়েছে:

“আমি কি তোমার বক্ষ প্রশস্ত করিয়া দিই নাই? আমি লাঘব করিয়াছি তোমার ভার (ভিয্র্), যাহা ছিল তোমার জন্য অতিশয় কষ্টদায়ক।”

সূরা আ-ইনশিরাহ ১-৩

এই উক্তির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আল্-ফখ্র্ আর-রাযী বলেছেন যে, জিব্রাইল ফেরেস্তা মুহম্মদ কাছে এলেন, তাঁর বুক ফেড়ে ফেললেন, তাঁর হৃৎপিন্ড বের করে নিলেন, সেটাকে ধুয়ে-মুছে গুনাহ্-খাতা থেকে পাক সাফ করলেন, তারপর সেটাকে জ্ঞান আর ঈমান দিয়ে ভরাট করলেন।

মুহম্মদ ইবনে ইসহাক্ব থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে ইবনে হিশাম এর ব্যাখ্যা দান করেছেন এই বলে:

“মুহম্মদের একদল সাহাবী একবার তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে আল্লাহ্‌র রসূল, আপনার নিজের কথা আমাদের কিছু বলন, তিনি উত্তর দিলেন, ‘বনী-সা’দের মধ্যে আমি লালিত। একদিনের কথা- আমার পালিত- ভাইদের সঙ্গে আমাদের বাড়ীর পেছনে ছিলাম, পশুর পাল চরাচ্ছিলাম। তখন সাদা পোশাক-পরা দুজন লোক আমাদের কাছে এলেন।তাঁদের একজনের হাতে তুষারে ভরা একটা সোনালী গামলা। তাঁরা আমাকে নিয়ে গেলেন, আমার দেহ ফাঁক করে ফেললেন আর ভেতর আর ভেতর থেকে এক দলা কালো রক্ত বের করে দূরে ফেলে দিলেন। তারপর, সেই তুষার দিয়ে তাঁরা আমার হৃদপিন্ড আর শরীর ধৌত করলেন। তাঁদের একজন অন্যজনকে বললেন,তাঁকে (মুহম্মদকে) তাঁর দশজন লোকের বিপরীত ওজন করো। অন্যজন তাই করলেন, আর আমি তাঁদের চাইতে বেশী ভারী হলাম। তারপর তিনি বললেন তাঁকে তাঁর একশজন লোকের বিপরীতে ওজন করো। তিনি তাই করলেন,আর আমার ওজন তাদের চাইতে বেশী হল। তারপর তিনি বললেন, তাঁকে তাঁর একহাজার লোকের বিপরীতে ওজন করো। তিনি তাই করলেন, আর আমি এবারও তাদের চাইতে বেশী ভারী হলাম। তখন তিনি বললেন, তাঁকে যেতে দাও, কেননা আল্লাহ্‌র কসম, তাঁকে যদি তাঁর সমস্ত লোকের বিপরীতে ওজন করা হয়, তাহলেও তিনি সবার চাইতে বেশী ভারী হবেন।’”

৪। আয-যালাল ( (পথ ভ্রষ্ট হওয়া, বিভ্রান্তি)। কোরান শরীফে বলা হয়েছে:

“তোমার (মুহম্মদের) প্রতিপালক তো তোমাকে অনুগ্রহ দান করিবেনই এবং তুমি সন্তুষ্ট হইবে। তিনি কি তোমাকে পিতৃহীন অবস্থায় পান নাই এবং তোমাকে আশ্রয়দান করেন নাই?”

وَلَسَوْفَ يُعْطِيكَ رَبُّكَ فَتَرْضَى أَلَمْ يَجِدْكَ يَتِيمًا فَآوَى

সূরা আয-যুহা ৯৩:৫-৬

আল-কালবী“পিতৃহীন অবস্থা” বলতে “ঈমানহীনতা” বুঝিয়েছেন।

৫। الكفر আল-কুফ্‌র্ (আল্লাহে অবিশ্বাস, নাস্তিক্য)।-কোরান শরীফে ঈমানদারদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে:

وَاعْلَمُوا أَنَّ فِيكُمْ رَسُولَ اللَّهِ لَوْ يُطِيعُكُمْ فِي كَثِيرٍ مِّنَ الْأَمْرِ لَعَنِتُّمْ وَلَكِنَّ اللَّهَ حَبَّبَ إِلَيْكُمُ الْإِيمَانَ وَزَيَّنَهُ فِي قُلُوبِكُمْ وَكَرَّهَ إِلَيْكُمُ الْكُفْرَ وَالْفُسُوقَ وَالْعِصْيَانَ أُوْلَئِكَ هُمُ الرَّاشِدُونَ

“……….আল্লাহ……….সত্যপ্রত্যাখ্যান (কুফ্‌র্),সত্যত্যাগ (ফুসূক্ব) ও অবাধ্যতাকে (’ইসয়ান) করিয়াছেন তোমাদিগের নিকট অপ্রিয় (ঘৃণ্য-(‘র্কারাহা)।”

সূরা আল-হুজরাত ৪৯:৭

আয-যামাখশরী এই আয়াতের তফসীরে বলেছেন,“এখানে তিনটি বিষয় রয়েছে: কুফ্‌র্ অর্থাৎ আল্লাহ্কে অস্বীকার করা, ফুসূক্ব অর্থাৎ অসত্যতা, ও ’ইস্য়ান অর্থাৎ অবাধ্যতা।”

৬। ظلم আয-যুল্ম্ (অন্যায়,অবিচার ,অন্যায্যতা)।-বলা হয়েছে:

وَإِذْ نَادَى رَبُّكَ مُوسَى أَنِ ائْتِ الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ

“যখন তোমার প্রতিপালক মূসাকে ডাকিয়া বলিলেন, তুমি সীমা লঙ্ঘনকারী (আয-যালিমীন) সম্প্রদায়ের নিকট যাও।”

সূরা আশ-শু’আরা ২৬:১০

৭। আল-ইথ্ম (অপরাধ, অপকর্ম, পাপ)।-কোরআন শরীফে রয়েছে:

وَذَرُواْ ظَاهِرَ الإِثْمِ وَبَاطِنَهُ إِنَّ الَّذِينَ يَكْسِبُونَ الإِثْمَ سَيُجْزَوْنَ بِمَا كَانُواْ يَقْتَرِفُونَ

“তোমার প্রকাশ্য এবং প্রচ্ছন্ন পাপ (ইথ্ম্) বর্জন কর; যাহারা পাপ (ইথ্ম্) করে, তাহাদিগকে তাহাদিগের পাপের সমুচিত শাস্তি দেওয়া হইবে।”

সূরা আন’আম ৬:১২০

৮। আল-ফুজূর (নীতিবিগর্হিত কাজ, চরিত্রহীনতা)।-কোরান শরীফে বলা হয়েছে।:

وَإِنَّ الْفُجَّارَ لَفِي جَحِيمٍ يَصْلَوْنَهَا يَوْمَ الدِّينِ

“এবং দুষ্কৃতকারীগণ (আল-ফুজ্জর) তো থাকিবে জাহান্নামে। উহারা কর্মফল দিবসে উহাতে প্রবেশ করিবে।”

সূরা আল ইনফিতার ৮২:১৪-১৫

৯। আল-খাতী’আ (পাপ, দোষ)।-কোরান শরীফে রয়েছে:

وَمَن يَكْسِبْ خَطِيئَةً أَوْ إِثْمًا ثُمَّ يَرْمِ بِهِ بَرِيئًا فَقَدِ احْتَمَلَ بُهْتَانًا وَإِثْمًا مُّبِينًا

“কেহ কোন দোষ (খাতী’আ) বা পাপ (ইথ্ম্) করিয়া পরে উহা কোন নির্দোষ ব্যক্তির প্রতি (উপর) আরোপ করিলে সে [নিজেই] মিথ্যা অপবাদ (বুহ্তান) ও স্পষ্ট পাপের বোঝা বহন করে।”

সূরা আন-নিসা ৪:১১২

এই আয়াতে পাপের জন্য যে তিন প্রকারের অভিধা ব্যবহৃত হয়েছে, ইমাম আর-রাযী তার উপর নিম্নরূপ পার্থক্য নির্ধারণ করেছেন:

  1. ১। আল-খাতী’ আ হচ্ছে ছোট পাপ আর আল-ইথ্ম্ বড় পাপ।
  2. ২। আল-খাতী’আ হচ্ছে এমন দোষ, যা স্বয়ং পাপীকেই ভোগায়, কিন্তু আল-ইথ্ম্ এমন অপরাধ যা সঙ্ঘটিত হয় অন্যদের বিরুদ্ধে, যেমন অবিচার, হত্যা ইত্যাদি।
  3. ৩। আল-খাতী’অ এমন দোষ, যা পূর্ব পরিকল্পিতও হতে পারে, আবার ভুলক্রমেও হতে পারে, কিন্তু তা করা উচিৎ নয়; আর ইথ্ম্ এমন পাপ, যা ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়।
  4. ৪। অন্যদিকে আল-বুহ্তান (অপবাদ) হচ্ছে কোন নির্দোষ লোককে অন্যায়ভাবে সন্দেহ করা। অপবাদ-রচনাকারীকে এই দুনিয়ায় কঠোরভাবে তিরস্কৃত করাএবং আখেরাতেও রয়েছে তার জন্য কঠোর শাস্তি।

১০। شَرًّا আশ্-শার্‌ (অনাচার)।- কোরান শরীফে বলা হয়েছে:

وَمَن يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَرَهُ

“এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে তাও দেখতে পাবে।”

সূরা যিলযাল ৯৯:৮

‘আব্দ্-আল্লাহ্ বিন ‘আম্র্ বিন’ আল-’আস-এর কাছ থেকে শুনে আবী ’আব্দ্ আর-রহমান আল-হুবালী, তাঁর কাছ থেকে শুনে ইয়াহ্-ইয়া বিন ’আব্দ্-আল্লাহ্ তাঁর কাছ থেকে শুনে ইবনে ওয়াহাব, তার কাছ থেকে শুনে ইউনুস বিন ’ আব্দ-আল-আ’লার দেওয়া বর্ণনা উদ্ধৃত করে আবু জাফর আৎ-তাবারী বলেছেন:

“এই সূরা যখন নাযেল হয়, তখন আব্ক্রু সিদ্দীক্ব বসেছিলেন। তিনি কাঁদতে লাগলেন। আল্লাহ্‌র রসূল জানতে চাইলেন, ‘আবুবকর, আপনি কাঁদছেন কেন?’ তিনি বললেন, আপনি যদি পাপ না করে থাকেন আর কোন ভুল না করে থাকেন, তাতে আপনি আল্লাহ্‌র ক্ষমা পাবেন। আবার আল্লাহ্ এমন সব লোকও সৃষ্টি করবেন, যারা পাপ করবে, ভুল করবে,তবু আল্লাহ্ তাদেরকে ক্ষমা করে দেবেন?”

১১। আস্-স্ইয়েআহ্ (অপকর্ম, অপরাধ)।- কোরান শরীফে বলা হয়েছে:

“যে কেহ মন্দকর্ম (আস-ইয়েআহ্)করিবে তাহাকে অধোমুখে নিক্ষেপ করা হইবে অগ্নিতে…।”

সূরা আন-নাম্ল্ ৯০

ইবনে ‘আব্বাস বলেছেন:

“আয়াতটি দেওয়া হলে-পর ঈমানদারগণ একে অসহনীয় বলে মনে করলেন। তাঁরা হযরত মুহম্মদকে বললেন, “আমাদের মধ্যে কে এমন আছে, যে মন্দ কর্ম করেনি? তাহলে কীভাবে আমরা তার খেসারত দেব?’ মুহম্মদ উত্তর করলেন, ‘একটি সৎকর্মের জন্য আল্লহ দশটি পুরষ্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আর একটি মন্দকর্মের জর‌্য একটি শাস্তির। সুতরাং হিসাবের খাতায় যার একটি মন্দকমর্ জমা হয়েছে, তার দশটি পুরষ্কারের একটি কাটা যাবে, তারপরও আরও নয়টি পুরষ্কার অবশিষ্ট থাকবে।’”

১২। আস-সূ’(কুকর্ম, ভাগ্যবিড়ম্বনা)। বলা হয়েছে:

“তোমাদের খেয়ালখুশী ও কিতাবীদের খেয়ালখুশী অনুসারে কাজ হইবে না; কেহ মন্দ কাজ (সূ’) করিলে তাহার প্রতিফল সে পাইবে না।”

সূরা আন-নিসা ১২৩

১৩। আল-ফাসাদ (অশান্তি, দুর্নীতি)। কোরআন শরীফে বলা হয়েছে:

“যখন সে (মুনাফিক্ব) তোমার নিকট হইতে ] প্রস্থান করে, তখন সে পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে (লিয়ুফসিদা) এবং শস্যক্ষেত্র ও জীবজন্তুর বংশনিপাতের চেষ্টা করে; কিন্তু আল্লাহ্ অশান্তি (আল-ফাসাদ) পছন্দ করেন না।”

সূরা বাকারা ২০৫

১৪। আল-ফিস্‌ক্ব (বদভ্যাস,নৈতিক অধঃপতন)। কোরান শরীফে লিখিত হয়েছে:

“এবং নিশ্চয় আমি তোমার প্রতি স্পষ্ট নিদর্শন (আয়াত) অবতীর্ণ করিয়াছি। সত্য ত্যাগীগণ (ফাসিকূর-অন্য অনুবাদ: ‘উচ্ছৃঙখল ফাসিক’হাকীম আবদুল মান্নান, ‘কোরান শরীফ’ তরজমা, ’তাজ কোম্পানী লিঃ) ব্যতীত অন্য কেহ তাহা প্রত্যাখ্যান করে না।”

সূরা বাকারা ৯৯

তফসীরকারগণ বলেছেন যে, আল্লাহ্ যা সীমাবদ্ধ করে দিয়েছেন, তার বাইরে চলে যাওয়াই হচ্ছে আল-ফিসক্ব এবং ফাসেক্ব ঈমানহীন।

১৫। আল-বুহতান (অপবাদ, অসত্যাচারণ)।-বলা হয়েছে:

“এবং তোমরা যখন ইহা শ্রবণ করিলে, তখন কেন বলিলে না, এ বিষয়ে বলাবলি করা আমাদিগের উচিৎ নহে; আল্লাহ্ পবিত্র মহান্। ইহা তো গুরুতর অপবাদ !’”

সূরা আন-নূর-আলোক ১৬

এমনিভাবে পাপের বর্ণনা দেবার জন্য কোরআন শরীফে আরও বহু শব্দ রয়েছে। কিন্তু সেই রকমের সমস্ত শব্দ আর তার তফসীরের বিবরণের জন্য স্থান-সঙ্কুলান এখানে সম্ভব নয়। তবে পাপ সম্পর্কে কথা শেষ করার আগে অবশ্যই বলা দরকার যে, “কোরান শরীফে মৌলিক” পাপ এর অস্তিত্বের বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে; এই পাপ সৃষ্টি হয়েছে হযরত আদম ও বিবি হাওয়ার বেহেশ্‌ত থেকে বহিষ্কৃত হবার কারণে, এবং এই বক্তব্যের প্রমাণ রয়েছে। তার মধ্যে সব চাইতে স্পষ্ট ও সহজ আয়াত ক’টি হচ্ছে নিম্নরূপ:

“এবং আমি বলিলাম, ‘হে আদম ! তুমি ও তোমার সঙ্গিনী (‘যাউজুকা’-অন্য অনুবাদ:‘তোমার স্ত্রী’, হাকীম আবদুল মান্নান, পূর্বোক্ত) জান্নাতে বসবাস কর এবং যথা ও যেথা ইচ্ছা আহার কর, কিন্তু এই বৃক্ষের নিকটবর্তী হইও না; হইলে তোমরা অন্যায়কারীদের (আয-যালিমীন) অন্তর্ভুক্ত হইবে।’ কিন্তু শয়তান উহা হইতে তাহাদের পদস্খলন ঘটাইল এবং তাহারা যেখানে ছিল, সেখান হইতে তাহাদিগকে বহিস্কৃত করিল। আমি বলিলাম, তোমরা একে অন্যের শত্রু রূপে নামিয়া যাও (‘ইহ্বিতু’) পৃথিবীতে কিছুকালের জন্য তোমাদের বসবাস ও জীবিকা রহিল।’ অতঃপর আদম তাহার প্রতিপালকের নিকট হইতে কিছু বাণী প্রাপ্ত হইল। আল্লাহ্ তাহার প্রতি ক্ষমাপরবশ হইলেন। তিনি অত্যন্তক্ষমাপরবশ, পরম দয়ালু।”

সূরা বাকারা ৩৫-৩৭

পতনের বা নেমে যাবার আগে হযরত আদম ও বিবি হাওয়া প্রকৃত কোথায় অবস্থান করছিলেন, তাই নিয়ে আরবি আলেমদের মধ্যে মতভেদ লক্ষ্য করা যায়।

আবু ক্বাসিম আল-বালখী ও আবু মুসলিম আল-ইসফাহানী বলেছেন যে, ফেরদৌস (উদ্যান) ছিল পৃথিবীতে। তাঁদের অনুযায়ী, পতন বা নেমে যাওয়া (আল-ইহ্বাৎ’) হচ্ছে এক যায়গা থেকে অন্যত্র স্থানান্তর, কেননা কোরান শরীফে অপসারণ অর্থে নেমে যাওয়া (ইহবাৎ)ক্রিয়াপদটি ব্যবহৃত হ্রয়ছে। যেমন, এক স্থানে [হযরত মূসার উম্মতদের প্রসঙ্গে] বলা হয়েছে যে, ‘তোমরা মিসরে নেমে যাও ’ (কিংবা ‘তোমরা কোন শহরে নেমে যাও’-‘ইহবিতু মিসরান’)। (দ্রষ্টব্য সূরা বাকারা ৬১

কিন্তু আজ-জাব্বাঈ বলেছেন যে, ফেরদৌস (উদ্যান) রয়েছে সপ্তম আসমানে, তাই ‘সেখান থেকে নেমে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে।

লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে যে, এই প্রসঙ্গে কোরান শরীফের উক্তি তওরাত শরীফের পয়দায়েশ-খন্ডের বিবরণের সঙ্গে মিলে যায়। তওরাত শরীফেও ফেরদৌসের নির্দিষ্ট কোন গাছের ফল খাওয়াকে হযরত আদমের অবাধ্যতা বলে দেখানো হয়েছে।

যাই হোক, এই গাছের ব্যাপারে মুসলিম আলেমগণ মতভেদ পোষণ করেছেন। তাঁরা বহু বিবরণ দিয়েছেন এবং সব বিবরণই প্রস্তুত হয়েছে হাদীস শরীফের প্রমাণের ভিত্তিতে। যেমন:-

‘আব্দ আর রায্যাক্বের উদ্ধিৃতি দিয়ে ইসহাক্ব বলেছেন: “ইবনে ‘উয়াইনা ও ইবনে মুবারক ও আল-হাসান বিন, ‘আমারা ও মিনহাল বিন ‘আমরূ ও সা’ঈদ বিন জুবাইর ও ইবনে ‘আব্বাস আমাদের জানিয়েছেন যে, হযরত আদম ও তাঁর স্ত্রীকে আল্লাহ্ যে গাছ নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন, তা হচ্ছে শস্যের একটি শিষ।”

‘ইবনে হামিদ বলেছেন, ইবনে ইসহাক্ব, ইয়ামানের কিছু লোক, ও ওয়াহাব বিন মুনাব্বিহ্ আল-ইয়ামানীর উদ্ধিৃতি সালামা তাঁকে জানান যে, সেটা ছিল গম; কিন্তু এই গমে একটি মাত্র দানা আকারে ছিল গাভীর একটা গুর্দার সমান আর তা ছিল মাখনের চাইতে নরম, মধুর চাইতে মিষ্টি।

*কথিত আছে, আবু বক্র সিদ্দিক্ব আল্লাহ্‌র রসূলের কাছে গাছটি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বললেন, “এই জান্নাতী গাছ হচ্ছে শস্যের একটি শিষ।”

*সালামা বলেছেন, মুহম্মদ বিন ইসহাক্ব ও ইয়াকুব বিন ‘আতাবা তাঁকে জানান যে, ফেরেশতারা এই গাছকে ঘর্ষণ করে অমরত্ব দান করেছিলেন।

*ইবনে ওয়াকীঅ’ বলেছেন, তিনি ‘আব্দ্ আল্লাহ্‌র কাছ থেকে যিনি ইসরাঈলের কাছ থেকে, যিনি আস-সাদ্দীর কাছ থেকে, যিনি ইবনে ‘আব্বাসের কাছ থেকে জানতে পারেন যে, সেটা ছিল আঙুর-গাছ।

*মুজাহিদ ও ক্বাতাদা বলেছেন, গাছটা ছিল ডুমুর-জাতীয়।

*আর-রবীঅ’ইবনে ঊনস্ বলেছেন যে, সেই গাছের ফল যে খাবে, তার দাস্ত হবে, আর ফেরদৌস এমন জায়গা, যেখানে মল ত্যাগ করা উচিৎ নয়।

শয়তানের প্ররোচনায় হযরত আদম ও বিবি হাওয়া নিষিদ্ধ ফল খাবার জন্য সেই গাছের কাছে গিয়েছিলেন, কোরান শরীফের এই বর্ণনাও তৌরাত শরীফের পয়দায়েশ-খন্ডের বর্ণনার সঙ্গে মিলে যায় এবং এখানে কোরান শরীফের বিবরণে রয়েছে, “শয়তান তাহাদের পদস্খলন ঘটাইল” “আযাল্লা-হুমাষ-শাইতান”)।

ইবনে ‘আব্বাসের উদ্ধৃতি দিয়ে ইবনে জুরাইজ বলেছেন, “শয়তান তাহাদের পদস্খলন ঘটাইল” বলতে বুঝতে হবে “শয়তান তাদেরকে পলুব্ধ করে বিপথে চালিত করল”।

কোরান শরীফের শিক্ষা-অনুযায়ী হযরত আদম ছিলেন নবী, আর ইসলামের শিক্ষায় নবীরা হলেন অভ্রান্ত।এর ফলে হযরত আদমের “পতনে’র ব্যাপারটা সমসার সৃষ্টি করেছে। তফসীরকারেরা তাই এ সমসার সমাধান করেছেন পলায়নবাদী মনোভব পোষণ করে। তাঁরা বলেছেন যে, হযরত আদম যখন আল্লাহ্‌র আদেশ অমান্য করেন, তখন তিনি নবী হননি, বরং পরে নবী হয়েছিলেন।কিন্তু এই মত সর্বসম্মত নয়। অন্যান্য তফসীরকার বলেছেন, হযরত আদম প্রথম থেকেই নবী ছিলেন, কিন্তু অন্যমনস্কতার কারণে তাঁর পতন ঘটে। দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে তাঁরা বলেছেন, যেমন রোযা রেখে কেউ ভুলবশতঃ কিছু খেয়ে ফেলেন, কেননা তাঁদেরকে জীবনের অন্যান্য কাজে লিপ্ত থাকতে হয়। এমন মতও রয়েছে যে বিবি হাওয়া হযরত আদমকে মদ পান করিয়েছিলেন এবং নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তিনি এই পাপে লিপ্ত হন।

এই ব্যাখ্যা কেমন করে গ্রহণযোগ্য হতে পারে, আমরা তা বুঝতে পারি না। কারণ, কোরান শরীফে রয়েছে:

“অতঃপর আদম তাহার প্রতিপালকের নিকট হইতে কিছু বাণী প্রাপ্ত হইল। আল্লাহ্ তাহার প্রতি ক্ষমাপরবশ হইলেন। তিনি অত্যন্ত ক্ষমাপরবশ, পরম দয়ালু।”

সূরা বাকারা ৩৭

তিনি পাপ না করে থাকলে আল্লাহ্‌র ক্ষমার প্রশ্ন উঠত না। সুতরাং তিনি নিশ্চয় জেনেশুনে পাপ করেছিলেন। অবশ্য কিতাবুল মুক্বাদ্দসে বলা হয়েছে যে, এই পাপের জন্য বিবি হাওয়াকে তিনি দায়ী করতে চেষ্টা করেন।

অন্যদিকে বহু আলেমের মত হচ্ছে, হযরত আদম ইচ্ছাকৃতভাবে সেই নিষিদ্ধ গাছের ফল খান। যেমন:-

ইউনিস ‘আবদ্-আল-আ’লা ও ওয়াহাব ও ইবনে বাইদের উদ্ধৃতি দিয়ে আবু জা’ফর আৎ-তাবারী “আদম কর্তৃক আল্লাহ্‌র কিছু বাণী লাভ” কথাটার ব্যাখ্যায় বলেছেন, “এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্ তাঁদেরকে বলতে শিখিয়েছেন,‘হে আমাদের প্রতিপালক, আমরা অন্যায় করেছি; তুমি যদি আমাদের ক্ষমা না করো, আমাদের উপর রহম না করো তাহলেতো নিশ্চয় আমরা তলিয়ে যাব।”

“আম্র্ বিন হাম্মাদ ও আসবাৎ ও আস-সাদ্দীর উক্তি উদ্ধৃত করে মূসা বিন হারুন কোরান শরীফের এই একই আয়াতের এইরূপ ব্যাখ্যা দিয়েছেন:“আদম আল্লাহ্কে বললেন, ‘তুমি কি নিজের হাতে আমাকে তৈরী করোনি? ‘উত্তর এল, ‘হ্যা।’ ‘তুমি কি তোমার রূহ আমার মধ্যে ফুকে দাওনি?’ ‘উত্তর এল, ‘হ্যাঁ।’ ‘তোমার রহমত কি তোমার ক্রোধের গজবকে ছাড়িয়ে যায় না?’ উত্তর এল, হ্যাঁ।’ হে আল্লাহ্ আমি যে, এই পাপ করব, তুমি কি তা আগে থেকেই স্থির করে রেখেছিলে?’ উত্তর এল, ‘হ্যাঁ’ তখন আদম জানতে চাইলেন, ‘আমি যদি তওবা করি আর সংশোধিত হই তুমি কি আবার আমাকে ফেরদৌসে (উদ্যানে) ফেরত পাঠাবে না?’ আল্লাহ্ বললেন, ‘হ্যাঁ’। তারপর, আল্লাহ্ তার তওবা কবুল করলেন, তাঁর উপর সন্তুষ্ট হলেন এবং তাঁকে চালিত করলেন।

আর একটি বিবরণ দিয়েছেন মুহম্মদ বিন বাশ্শার, যিনি তা উদ্ধৃত করেছেন ‘আব্দ্-আর-রহমান বিন মাহ্দী থেকে, মাহদী তা জেনেছেন সুফিয়ানের কাছ থেকে, সুফিয়ান তা পেয়েছেন ‘আবদ্-আল-আযীয বিন রফীঅ’র কাছ থেকে, রফীঅ’ আবার তা জানতে পেরেছেন এমন এক ব্যক্তির কাছ থেকে, যিনি বলতে শুনেছেন ‘উবাইদ বিন “উমাইরকে যে, আদম বললেন, “হে আল্লাহ্, আমি যে পাপ করেছি, সেটা কি আগে থেকেই তুমি স্থির করে রেখেছিলেন, নাকি তা আমারই নিজের সৃষ্টি?” “আল্লাহ বললেন, “তুমি যদি আগে থেকেই আমার জন্য তা স্থির করে রেখে থাকো, তাহলে আমাকে ক্ষমা করে দাও।” তখনকার এই উপলক্ষে আয়াতটি আসে যে, আদম আল্লহার কাছ থেকে কিছু বাণী লাভ করলেন।

হযরত আদম যে স্বেচ্ছায় পাপ করেছিলেন, এই সত্য কিন্তু এত সব ব্যাখ্যা থেকে খারিজ হয়ে যাচ্ছে না। আল-ফখ্র্ আর-রাযীও ঠিক তাই মনে করেছেন। তাঁর ভাষায়ঃ-

“মানুষের ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে যে সব আয়াতের সম্পর্ক বলে আলেমরা মনে করেন, তার সংখ্যা অনেক। তার মধ্যে আদমের ঘটনাকে নিয়ে লেখা আয়াতটিই হবে প্রথম। এর উপর সাতটি মত রয়েছেঃ

  1. “তিনি অবাধ্য ছিলেন, আর অবাধ্যতা দুইভাবে মহাপাপ। প্রথমতঃ, কোরানের চাহিদা হচ্ছে, সর্বশক্তিমানের কথা-অনুযায়ী আদমকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে, কেননা আল্লাহ বলেছেন, ‘আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের যে অবাধ্যতা করে, জাহান্নামের আগুন তার প্রাপ্য।’ দ্বিতীয়তঃ, ‘অবাধ্য’ কথাটা এমনই অসম্মানজনক যে, মহা পাপিষ্ঠ ছাড়া অন্য কারো উপর তা আরোপ করা উচিৎ নয়।
  2. “আদমের ঘটনা থেকে দেখা যায় যে, তাঁকে প্রলোভিত করা হয়েছিল, কেননা কোরআন শরীফেই আছে যে, তাঁকে প্রলোভিত করা এবং প্রলোভিত হওয়া সদাচারের পরিপন্থী।
  3. “তিনি অনুতপ্ত হন, তওবা করেন, আর অনুতাপকারীও অপরাধী। অনুতাপ আসে অপরাধের অনুশোচনা থেকে। এইভাবে যার মনে অনুশোচনা এসেছে, সেই ব্যক্তিই নিজেকে অপরাধী বলে স্বীকার করে। যদি স্বীকারোক্তিতে কেউ মিথ্যা বলে, তাহলে মিথ্যাচারের অপরাধেও সে অপরাধী, আর সত্য বললে সে নিজেই তার অপরাধের প্রমাণ দিচ্ছে।
  4. “আল্লাহ্ যা করতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন, আদম ঠিক সেইটাই করেছেন। আল্লাহ্ বলেছেন, ‘আমি কি তোমাদের দুজনের জন্যই ঐ গাছ নিষিদ্ধ করে দিইনি?’ তিনি আরও বলেছেন, ‘আমি কি বলিনি, ঐ গাছের কাছে যেও না? ঠিক যেটা নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেইটাই করা মারাত্মক অপরাধ।
  5. আল্লাহ্ নিজেই আদমকে ‘সীমা লঙ্ঘনকারী’ বলেছেনঃ ‘তাহলে তুমি সীমা লঙ্ঘনকারীদের মধ্যে গণ্য হবে।’ এই আয়াতে আদমও নিজেকে সীমা-লঙ্ঘনকারী বলেছেনঃ “হে পরওয়ারদেগার, আমরা নিজেরাই সীমা লঙ্ঘন করেছি। আল্লাহর কথাতেই দেখা যায় যে,সীমা-লঙ্ঘনকারী অভিশপ্ত। ‘সত্যই সীমা-লঙ্ঘনকারীর উপর আল্লাহ্‌র অভিশাপ থাকবে।’ যে ব্যক্তি এহেন অভিশাপ অর্জন করেছেন, তিনি নিশ্চয় মহা-পাপিষ্ঠ।
  6. “আদম স্বীকার করেন যে, আল্লাহ্ যদি তাঁকে ক্ষমা প্রদর্শন না করেন, তাহলে, যারা সব-কিছু হারিয়েছে, তিনি তাদের একজন হবেন। এইভাবে তিনি নিজেই নিজেকে মহা-পাপিষ্ঠ ঘোষণা করেন।
  7. “শয়তানের শঠতার কারণে তাঁকে ফেরদৌস থেকে বহিস্কার হতে হয়। শয়তানের বশ্যতা স্বীকার করার ক্ষতিপূরণ হল তাঁর এই অধঃপতন। এর থেকেই স্পষ্ট হয় যে, তিনি মহাপাপ করেছিলেন।”

শয়তান কীভাবে ফেরদৌসে (উদ্যানে) প্রবেশ করে এবং হযরত আদমকে প্রলোভিত করতে সক্ষম হয়, সেই নিয়েও আলেমদের মধ্যে মতভেদ লক্ষ্য করা যায়।

ওয়াহাব বিন মুনাব্বিহ্ ও আস-সাদ্দী ও ইবনে ‘আব্বাসের উদ্ধৃতি দিয়ে আল-ক্বাস্সাস বলেছেন: “শয়তান ফেরদৌসে প্রবেশ করতে গেলে ফেরেশ্‌তা-প্রহরীদের দ্বারা সে বাধাপ্রাপ্ত হয়। তখন সে জীব-জন্তুদের সহায়তায় প্রবেশের চেষ্টা করলে সবাই তাকে প্রত্যাখ্যান করে। এরপর সে সরীসৃপের শরণাপন্ন হয়। চারপায়ে দ্রুত হাঁটতে সক্ষম এই প্রাণী এগিয়ে আসে সাহায্য করতে। সুতরাং শয়তানকে সে গিলে, পেটের মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে গোপনে ফেরদৌসে প্রবেশ করে। সরীসৃপের পেট থেকে বের হয়ে শয়তান অতি-দ্রুত কুমন্ত্রণা ছড়াতে থাকে ফেরদৌসের মধ্যে। বলা বাহুল্য, সরীসৃপ অভিশপ্ত হয়ে চারটি পা-ই হারায় এবং বুকে হাঁটা অভ্যাস করতে হয় তাকে। জীবন ধারণের উপায় খুঁজে বেড়াতে হয় ধুলো মাটির মধ্যে এবং পরিণত হয় আদম-সন্তানের শত্রুতে।

আৎ-তাবারী তাঁর “জামীঅ’ আল-বয়ান” গ্রন্থে আল-হাসান আবী ইয়াহ্ইয়া ও আব্দ-আর-রায্যাক্বের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন:

“আমরা ‘আম্র্ বিন‘আবদ্-আর-রহমান বিন মুহাররিবের কাছ থেকে জেনেছি, তিনি ওয়াহাব বিন মুনাব্বিহ্কে বলতে শুনেছেন যে, আল্লাহ্ যখন আদম ও তাঁর বংশধরদের ফেরদৌসে রাখলেন, তখন তিনি তাঁদেরকে নির্দিষ্ট গাছটার কাছে যেতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন। গাছটার পাকানো-পেঁচানো অনেক ডালপালা আর সেই ডালপালায় অনেক ফল। ফেরেশতারা সেই ফল খান অমরত্বলাভের উদ্দেশ্যে। আল্লাহ্ এই ফল খেতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন আদম ও তাঁর স্ত্রীকে। শয়তান যখন চাইল, তাঁদের পতন হোক, তখন সে সরীসৃপের পেটের মধ্যে ঢুকল। এই সরীসৃপের চারটি পা, আর আল্লাহ্ তাকে সৃষ্টি করেছিলেন অতি-উত্তমভাবে হাঁটতে সক্ষম প্রাণী হিসেবে। সরীসৃপ ফেরদৌসে প্রবেশ করলে তার পেট থেকে শয়তান বেরিয়ে এল এবং নিষিদ্ধ গাছের ফল পেরে নিয়ে গেল হাওয়ার কাছে। বলল, দেখ, কী চমৎকার এই ফলের গন্ধ, কী মজাদার এই ফল খেতে, আর কী সুন্দর এর রং!’ তাই শুনে হাওয়া তা খেলেন, আর নিয়ে গেলেন আদমের কাছে। বললেন, ‘দেখ, কী চমৎকার এই ফলের গন্ধ, কী মজাদার এই ফল খেতে, আর কী সুন্দর এর রং !’ তাই শুনে আদমও খেলেন সেই ফল এবং তাদের মধ্যে লজ্জানুভূতি দেখা দিল। আদম গাছের গর্তের মধ্যে লুকালেন। আল্লাহ তখন তাঁকে ডাকলেন, ‘কোথায় তুমি, হে আদম?’ তিনি উত্তর করলেন, ‘হে পরওয়ারদেগার, এই যে, আমি এখানে।’ আল্লাহ্ প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কি আর ওখান থেকে বের হয়ে আসবে না?’ আদম বললেন, হে পরওয়ারদেগার, আমি তোমার সামনে বের হতে বিব্রত বোধ করছি।’ তখন আল্লাহ্ বললেন, ‘যে মাটি দিয়ে তোমাকে তৈরী করা হয়েছে, অভিশাপ সেই মাটির উপর, আর এই অভিশাপ, এর ফল-কে পরিণত করুক কাঁটায়।’(ফেরদৌসে কিংবা পৃথিবীতে এই ফলের তুল্য কিছুই আর ছিল না, যা ছিল কলা ও পদ্মের চাইতে সরেস।) তারপর আল্লাহ্ বললেন, হে হাওয়া, তুমি আমার দাসকে প্রবঞ্চিত করেছ। তীব্র অনিচ্ছা-ভাব ছাড়া তুমি কখনও অন্তসত্ত্বা হবে না, আর যখন তুমি সন্তান প্রসব করতে চাইবে, তখন তোমার মরণদশা দেখা দেবে প্রায়ই।, সরীসৃপকে তিনি বললেন, ‘সর্বাধিক অভিশপ্তকে (শয়তানকে) তুমিই নিজের মধ্যে লুকিয়ে ফেরদৌসে নিয়ে এসেছিলে আমার দাসকে প্রবঞ্চিত করার জন্য। সুতরাং তুমি সর্বাংশে অভিশপ্ত। তোমার পা-গুলি তোমার পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে যাক। ধূলো-মাটির মধ্যে ছাড়া আর কোথাও তোমার জীবন ধারণের কোন উপায় থাকবে না। তুমি মানুষের শত্রু আর মানুষ হোক তোমার শত্রু। মানুষ দেখা-মাত্র তুমি তাকে ছোবল মারবে আর তোমাকে দেখা-মাত্র মানুষ তোমার মাথা গুড়িয়ে ফেলবে।’”

ইসলামী শরীয়তের অন্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে, আদম ও হাওয়া ফেরদৌসের সদর দরজার দিকে যাচ্ছিলেন- এমন সময় কাছাকাছি ওৎ পেতে-থাকা শয়তান এসে উপস্থিত হল আর কুমন্ত্রণা দিয়ে তাঁদেরকে বশীভূত করল।

যাইহোক, হযরত আদম পাপ করেছিলেন কিনা, কোরান শরীফ তা নিশ্চিত করে নির্ধারণ করে দিয়েছে, এবং সেখানে রয়েছে এই আয়াত দুটি:

“অতঃপর শয়তান তাহাকে (আদমকে) কুমন্ত্রণা দিল; সে বলিল, ‘হে আদম ! আমি কি তোমাকে বলিয়া দিব অনন্ত জীবনপ্রদ বৃক্ষের কথা ও অক্ষয় রাজ্যের কথা?’ অতঃপর তাহারা (আদম ও হাওয়া) উহার ফল ভক্ষণ করিল; তখন তাহাদিগের লজ্জাস্থান তাহাদিগের নিকট প্রকাশ হইয়া পড়িল এবং তাহারা উদ্যানের বৃক্ষপত্র-দ্বারা নিজদিগকে আবৃত করিতে লাগিল। আদম তাহার প্রতিপালকের অবাধ্য হইল, ফলে সে পথভ্রষ্ট হইল।”

সূরা তাহা ১২০-১২১

“ফলে সে পথভ্রষ্ট হইল” (“ফা-‘গাওয়া”)– এই উক্তির অন্তর্গত “পথভ্রষ্ট” শব্দটির উৎস-শব্দের অর্থ “ভ্রম”। আর-রাযী “পথভ্রষ্ট” শব্দের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন যে, এটি “ভ্রম” শব্দের সমার্থক। “ভ্রান্তির” বিপরীতার্থক শব্দ হবে “চরিত্রের সুদৃঢ়তাঃ। এই ধরনের পাপ কেবল এমন কলুষিত চরিত্রের লোকের দ্বারা সংঘটিত হতে পারে, যে অসৎ জীবনযাপনে ফিরে গেছে।

আবু ইমাম আল-বাহিলী বলেছেন:

“আদমের ঘটনাটা ছিল অতি-বিশেষ। আল্লাহ্ আদমের মধ্যে অবিরত বিশ্রাম আর সুশৃঙ্খল জীবনধারার আগ্রহ জাগিয়ে দিয়েছিলেন। কারণ, আল্লাহ্ বলেছেন; ‘সে (শয়তান) যেন কিছুতেই তোমাদিগকে জান্নাত (উদ্যান) হইতে বাহির করিয়া না দেয়, দিলে তোমরা দুঃখ-কষ্ট পাইবে।’‘ (ঐ:১১৭), ‘ এবং সেথায় (উদ্যানে) পিপাসার্ত হইবে না ও রৌদ্রক্লিষ্টও হইবে না।’ (ঐ :১১৯)

বিপরীতক্রমে শয়তানও আদমের মনে অবিরত সুখ আর সুস্থির জীবনের আগ্রহ এনে দিয়েছিল: ‘আমি কি তোমাকে বলিয়া দিব অনন্ত জীবনপ্রদ বৃক্ষের কথা ও অক্ষয় রাজ্যের কথা? ’ আল্লাহ্ আদমের মধ্যে যে আগ্রহ জাগিয়ে তোলেন, শয়তানও তাঁর মধ্যে জাগিয়ে তোলে সেই একই আগ্রহ। কিন্তু আল্লাহ্ সেজন্য শর্ত দেন যে, এই গাছের ফল স্পর্শ করবে না, বিপরীত পক্ষে শয়তান সেই নিষিদ্ধ ফলই খেতে আদমকে উদ্বুব্ধ করে। তাহলে, যখন দেখা যাচ্ছে যে, আদমের খঁাঁটি মন ছিল আর এই জ্ঞান ছিল যে, আল্লাহ্ তাঁর পরওয়ারদেগার, শিক্ষক আর সহায় এবং শয়তান তাঁর চরম শত্রু, তখন কেমন করে তিনি সেই শয়তানেরই কুমন্ত্রনা মেনে নিলেন আর আল্লাহ্‌র উপদেশ অগ্রাহ্য করলেন?”

সত্য বটে যে, তফসীর কারেরা তাঁদের ব্যাখ্যায় হযরত আদমের পাপ খন্ডন করতে পারেননি। কারণ, আমরা আগেই দেখেছি, কোরআন শরীফে তাঁর পাপের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এই ভাষায়:

“আদম তাহার প্রতিপালকের অবাধ্য হইল, ফলে সে পথভ্রষ্ট হইল।”

তফসীরকারেরা সবাই কোরান শরীফের আয়াতসমূহের উপর নির্ভর করে একমত যে, আল্লাহ্‌র অবাধ্যতা অপরাধ, এই অবাধ্যতা আল্লাহ্কে অবজ্ঞা করার সমতুল্য এবং এর চাইতে বড় পাপ আর হয় না। সুতরাং যে ব্যক্তি এই প্রকারের কঠোর শাস্তি পাবার উপযুক্ত পাপ করেছে, তাকে “মহা-পাপিষ্ঠ” নামে আখ্যায়িত না করবার কোন কারণ দেখা যায় না।

মসীহী মতে পাপ

মানবজাতির ইতিহাসে পাপের প্রকাশ সুস্পষ্ট। আমরা সবাই যদি নিজের নিজের অন্তঃকরণের খোঁজ নিই কিংবা অন্যের আচরণ লক্ষ্য করি, তাহলে অবশ্যই এই পাপ আমরা প্রত্যক্ষ করব। সকল মানুষ, এমন কি যাদের উপর আল্লাহ্‌র ওহি এসেছে, তাঁরা নিজেদের পাপ সম্বন্ধে সচেতন। তাঁরা স্বীকার করেন যে, তাঁরা পাপ করেছেন, তাঁদের মধ্যে ত্রুটি রয়েছে এবং নিজেদের উপর অর্পিত নৈতিক দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে পালন করতে তাঁরা অক্ষম।

অনেকে মনে করেন, পাপ খুবই লজ্জাজনক ব্যাপার। আসলে, পাপ কেবল লজ্জাজনক নয়, তার চাইতে অনেক বেশি কিছু।

পাপ আল্লাহ্-পাকের কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়াও বটে, যে আল্লাহ্-পাক হচ্ছেন আমাদের চরম, পরম ও একমাত্র লক্ষ্যস্থল। এই দূরে-সরে-যাওয়া কেবল যে মন্দের প্রতি ঝোঁক তাই নয়- বরং ভাল কাজ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া।

অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে, পাপের ক্ষমতা সম্পর্কে আর আমাদের মধ্যে পাপের প্রভাবের শক্তি সম্পর্কে একজন স্বাভাবিক মানুষের (ঘধঃঁৎধষ সধহ) উপলব্ধি থাকে না। ঈমানদার বান্দা ঈসা-কালেমাতুল্লাহ্‌র কাছ পর্যন্ত পৌঁছাবার উপায় হিসেবে আল্লাহ্-পাকের শরীয়ত অনুসরণ করেন। মসীহ্ তাঁকে রহমত দান করেছেন এবং সেই বান্দা জানেন যে, পথভ্রষ্ট করবার জন্য বাস্তবে পাপের কী মোহময় ক্ষমতা রয়েছে। সেজন্য তাঁর ক্ষেত্রে আল্লাহ্‌র রহমত আর কাফফারার জন্য রক্তের চাহিদার যে উপযোগিতা রয়েছে, তিনি সে ব্যাপারে সচেতন হয়ে ওঠেন।

সাধারন ভাবে পাপের অর্থ “খোদার শরীয়ত অমান্য করা”। (১ ইউহোন্না ৩:৪)। পাপীর বক্তব্য যা-ই থাকুক আর পাপ যতই ক্ষুদ্র হোক না কেন, আল্লাহ্ পাপ-মাত্রকেই অপছন্দ করেন।

জগতে পাপের আগমন

কিতাবুল মুক্বাদ্দস ইঞ্জিল শরীফের রোমীয়-খন্ডের ৫:১২ আয়াতে আমরা পড়ি:

“একটি মানুষের (আদমের) মধ্য দিয়া পাপ দুনিয়ায় আসিয়াছিল ও সেই পাপের মধ্য দিয়া মৃত্যুও আসিয়ছিল। সমস্ত মানুষ পাপ করিয়াছে বলিয়া এইভাবে সকলের নিকটই মৃত্যু উপস্থিত হইয়াছে।”
ইঞ্জিল শরীফ, রোমীয় ৫:১২

এখানে বলতে চাওয়া হয়েছে যে, সকল মানুষের পাপী হবার কারণ মানবজাতির পিতা হযরত আদম। “একটি মানুষের মধ্য দিয়া” কথাটা ব্যবহার করতে গিয়ে হযরত পৌল হযরত আদম ও বিবি হাওয়াকে একক-সত্তা হিসেবে দেখেছেন। তওরাত শরীফের পয়দায়েশ-খন্ডেও (৫:২) সেই উল্লেখ পাওয়া যায়। হযরত পৌলের বর্ণনায় সরীসৃপের প্রলোভন বা বিবি হাওয়ার অবাধ্যতার উল্লেখ নেই। কারণ, তাঁর কেবল এইটুকু দেখানো উদ্দেশ্য ছিল যে, পরবর্তী সকল বংশধরের প্রতিনিধি হযরত আদম।

কোন কোন দর্শনবিদ বলেন যে, মানব-শিশুর জন্ম হয় নিষ্পাপ অবস্থায়, পরে পাপপূর্ণ পরিবেশে বাস করতে গিয়ে সে সেই পরিবেশের দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং তার মধ্যে পাপ প্রবেশ করে। কিন্তু সত্য হচ্ছে যে, পাপের স্বভাব নিয়েই মানুষ জন্মগ্রহন করে। পাপপূর্ণ পরিবেশে পাপের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে বটে কিন্তু মানুষ নিজ অন্তঃকরণে মূলতঃই পাপী।

উত্তরাধিকার- সূত্রে পাপ

আমরা অভিজ্ঞতা থেকে জানি, কোন জীবন্ত প্রাণী নিজের প্রকৃতি থেকে ভিন্নতর অন্য কোন প্রাণীর জন্ম দিতে পারে না। ষাঁড় কখনও ভেড়ার জন্ম দেয় না। যেমন ঈসা কালেমাতুল্লাহ্ বলেছেন, “কাটাগাছে কখনও আঙ্গুর ধরে না।

মানুষের বেলায়ও এই বিধান প্রযোজ্য। মানবজাতির পিতা হযরত আদম আল্লাহ্‌র প্রতি অবাধ্যতার মধ্য দিয়ে নিজের সদাচারী জীবন হারিয়ে বসেন। এই পাপের শাস্তি হিসাবে তাঁকে নেমে আসতে হয় অভিশপ্ত পৃথিবীর মাটিতে। পৃথিবীতে এসে তিনি সন্তান-সন্ততি জন্ম দেন। কালক্রমে তাঁর বংশধরদেরকে ফেরদৌসের পবিত্রতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ থাকতে হয়। হযরত দাউদের ভাষায় ইঞ্জিল শরীফে এই সত্যের উল্লেখ রয়েছে:

“দেখ, অপরাধে আমার জন্ম হইয়াছে, পাপে আমার মাতা আমাকে গর্ভে ধারণ করিয়াছিলেন।”

জবুর শরীফ ৫১:৫

হযরত পৌলও বলেছেন:

“নির্দোষ কেহ নাই, একজনও নাই; কেহ খোদার বিষয়ে বুঝিতে পারে না, আর কেহ তাঁহাকে খোঁজেও না। সমস্ত মানুষই খোদার পথ হইতে সরিয়া গিয়াছে, সকলে এক সঙ্গে অপদার্থ হইয়া গিয়াছে। ভাল কাজ কেহই করে না, একজনও না।”

ইঞ্জিল শরীফ, রোমীয় ৩:১০-১২

অগাস্তাইন অধঃপাত সম্পর্কে আর পাপের উত্তরাধিকার সম্পর্কে কিতাবুল মুক্বাদ্দসের শিক্ষা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন:

  1. আল্লাহ্-পাক জ্ঞানে, সততায় ও পবিত্রতায় তাঁর নিজের মতো করে প্রথম মানুষটিকে সৃষ্টি করেন। তাঁকে তিনি সৃষ্টি করেন অমর করে। তাঁকে তিনি অন্যান্য প্রাণীর দায়িত্ব প্রদান করেন। আদমকে তিনি ভাল ও মন্দের মধ্যে পার্থক্য করবার ক্ষমতা দেন। এইভাবে আল্লাহ্-পাক আদমের শুদ্ধ নৈতিক প্রকৃতি গড়ে তোলেন।
  2. আদমকে নিজের পথে স্বাধীনভাবে চলবার ক্ষমতা দেওয়া হয়। কিন্তু শয়তানের প্ররোচনায় অন্যায় কাজ করে তিনি আল্লাহ্‌র বিরুদ্ধে পাপ করেন। যে জীবনের জন্য তাঁকে সৃষ্টি করা হয়েছিল, সেই জীবন থেকে তিনি পড়ে যান।
  3. তাঁর মধ্যে যে, আল্লাহ্‌র সাদৃশ্য ছিল, অবাধ্যতার কারণে তাঁকে তা হারাতে হয়। তাঁর সম্পূর্ণ প্রকৃতি দোষযুক্ত হয়ে যায়, তিনি তাবাহ্ হন। এখন রূহগতভাবে মৃত্যু হওয়ায় তিনি ভাল করবার অযোগ্য হয়ে পড়েন। দৈহিক মৃত্যুর যোগ্যতা অর্জন করায় এখন তিনি অনন্ত জীবন হারিয়ে বসেন এবং ইহজগতের সকল মন্দ ও অনন্ত মৃত্যুর বশীভূত হন।
  4. এইভাবে, গোটা মানবজাতির প্রধান হিসাবে আদমের জন্য যা-কিছু সত্য, তাঁর সকল বংশধরের জন্যও তাইই সত্য। তারা সবাই জন্মগতভাবে পাপী, আল্লাহ্‌র সাদৃশ্য থেকে মুক্ত, আর নৈতিকভাবে অধঃপতিত।
  5. আমল বা কাজের মাধ্যমে পাপ না করলেও উত্তরাধিকার-সূত্রে ব্যক্তিমাত্রই ত্রুটিপূর্ণ, দোষযুক্ত। সুতরাং, প্রত্যেক মানবসন্তান পাপী।
  6. আদমের পাপের কারণে মৌলিক সততা যে নষ্ট হয়ে যায় আর স্বভাবের মধ্যে যে দোষ দেখা দেয়, সেটাই হচ্ছে প্রথম পাপের শাস্তি।
  7. পুনরুদ্ধার হচ্ছে পাক-রূহের আশ্চর্যজনক কাজ। মানুষ এর লক্ষ্য-কর্তা নয়। ব্যতীক্রমহীনভাবে এর সম্পর্ক আল্লাহ্‌র অভিপ্রায়ের সঙ্গে। নাজাত বা মুক্তিই একমাত্র রহমত।

মানুষের উপর পাপের ফল

ইংরেজ বিজ্ঞানী হাক্সলী বলেছেন:

“এমন কোন গবেষণার কথা আমি জানি না, যে গবেষণা মানবজাতির বিবর্তনের চাইতে বড় কোন আত্মিক দুর্দশার বিষয় আবিষ্কার করতে পেরেছে। ইতিহাসের অন্ধকার প্রেক্ষাপট থেকে এই রকমই মনে করা যায় যে, মানুষ তার নিজের মধ্যে রক্ষিত এমন এক উপাদানের সম্পূর্ণ মুখাপেক্ষী, যে উপাদান ভয়ঙ্কর শক্তি দিয়ে তাকে দমিয়ে রাখছে। এমন কিছু তাড়না আছে, মানুষ যার অন্ধ ও দুর্বল শিকারে পরিণত, মানুষকে যা ধ্বংস করে ফেলেছে। সীমাহীন যত প্রবঞ্চনায় ভুগে প্রচন্ড মানসিক যন্ত্রণা তার জীবনের সম্বল হয়ে উঠেছে। ফলে তার বাইরের দেহটা দুশ্চিন্তা আর উত্তেজনায় ঝরঝরে, নড়বড়ে। হাজার হাজার বছর ধরে তার এই অবস্থা-সে লড়ছে, আর বধ করছে করছে তারই কোন সমগোত্রীয়কে, এবং ফিরে যাচ্ছে মৃতের জন্য অশ্রু বিসর্জন করতে আর তার কবরের উপর স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করতে।”

পাপের ফল বুঝবার জন্য কারও আর কী প্রমাণের প্রয়োজন থাকতে পারে? মানুষের পক্ষে তার নানা প্রবণতা আর খেয়ালখুশী আবিষ্কারের জন্য এবং নিজের মধ্যে বাসা বেঁধে থাকা পাপের উপস্থিতি টের পাবার জন্য নিজেরই অন্তঃকরণের গভীরে দৃষ্টি বুলিয়ে নেওয়াই কি যথেষ্ট নয়?

সকল মানুষের মধ্যে এই সত্য সম্পর্কে ধারণা পাবার জন্য মানব-সমাজের দিকে এক ঝলক নজর বুলিয়ে দেওয়াই যথেষ্ট। জবুর শরীফে (১৪:১) বলা হয়েছে:

“তাহারা নষ্ট হইয়াছে, তাহারা ঘৃণার্হ কর্ম করিয়াছে।”
জবুর শরীফ ১৪:১

এবং ইশাইয়া- খন্ডের (৫৩: ৬) উক্তি:

“আমরা সকলে মেষগণের ন্যায় ভ্রান্ত হইয়াছি, প্রত্যেকে আপন আপন পথের দিকে ফিরিয়াছি।” অধঃপতিত হবার আগে আদম আল্লাহর যে সাদৃশ্য ধারণ করতেন, আমরা সবাই সেই সাদৃশ্য থেকে বিবর্জিত।

কিতাবুল মোকাদ্দস, ইশাইয়া ৫৩:৬

প্রত্যেক মানষের মধ্যে পাপের বিদ্যমানতা অবিসংবাদিত। মানুষের মধ্যে ব্যক্তিগত মর্মপীড়া সত্ত্বেও নৈতিক আইন মেনে চলতে সে য অক্ষম, এই সত্য থেকেই মানুষের পাপাচারী স্বভাবটা স্পষ্ট। এ হচ্ছে তার অধঃপতন ও ব্যর্থতার প্রমাণ। তাকে অবশ্যই পাক রূহের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র সাহায্য লাভ করতে হবে। আজকে আমাদের কাছে অত্যন্ত স্পষ্ট যে, প্রথম মানুষের পতনের আগে তাঁর মধ্যে মৌলিক সততার যে গুণ ছিল, তার পর মানুষের আত্ম সেই গুণ থেকে বিবর্জিত হয়েছে।

বহু বছর যাবত জমে-ওঠা অপরাধের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা যথেষ্ট পরিমাণ চূড়ান্ত-রকমের প্রমাণ পাই যে, মানুষ খোদাই স্বভাব হারিয়ে ফেলেছে এবং পাপের স্বভাব আয়ত্ত্ব করেছে। আদমের পুত্র কাবিলের মধ্যে এই কুপ্রবৃত্তি আমরা প্রথম দেখতে পাই। তিনি নিজের ভাই হাবিলকে হত্যা করেন। কেন হত্যা করেন? কাবিলের মধ্যে কুপ্রবৃত্তি প্রবেশ করেছিল বলে নয় কি? আমরা কেন একে অন্যের সাথে ঝগড়া করি? আমাদের মনের গভীরে অদম্য কুপ্রবৃত্তি প্রবেশ করেছে বলে নয় কি? কেন এক জাতি অন্যজাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে? সকল মানুষের পুঞ্জীভূত পাপের কারণে নয় কি?

পাপের মজুরী তৌরাত শরীফে রয়েছে, আল্লাহ্ আদমকে বলেন:

“নেকী-বদী জ্ঞানদায়ক যে বৃক্ষ, তাহার ফল খাইও না কেননা যেদিন তাহার ফল খাইবে, সেইদিন মরিবেই মরিবে।”

তৌরাত শরীফ, পয়দায়েশ ২:১৭

হিজকিল-খন্ড ১৮:১০):

“যে প্রাণী পাপ করে, সেই মরিবে।”

কিতাবুল মোকাদ্দস, হিজকিল ১৮:১০

ইঞ্জিল শরীফের রোমীয় ৬:২৩:

“পাপ যে বেতন দেয় তাহা মৃত্যু।”

ইঞ্জিল শরীফ, রোমীয় ৬: ২৩

হযরত আদম ও বিবি হাওয়া পাপ করার সঙ্গে সঙ্গে রূহানী দিক্ দিয়ে মারা যান, আল্লাহ্‌র কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন এবং আল্লাহ্‌র সঙ্গে পাক রূহের একাত্মতা হারিয়ে বসেন। শুধু তাই নয়- তাঁদের মধ্য থেকে আল্লাহ্‌র সান্নিধ্যলাভের ইচ্ছাও বিলুপ্ত হয় এবং তাঁর কাছ থেকে লুকাবার জন্য ফেরদৌসের গাছের আড়ালে গিয়ে আশ্রয় নিতে হয় (পয়দায়েশ-খন্ড ৩: ৮)। সম্ভবতঃ দৈহিক শক্তির অভাবের জন্য কিংবা কোন অসুস্থতার জন্য তাঁরা আল্লাহ্‌র এই সতর্ক বাণী মনে রাখতে পারেন নি যে, “যেদিন তাহার ফল খাইবে সেইদিন মরিবেই মরিবে।”

কারও পাপের ফলভোগ সামনাসামনি দেখতে পেলে সে হবে নিশ্চয় ভয়বহ অভিজ্ঞতা। কিন্তু প্রথম মানব পরিবার কি সত্যই সকল সুযোগ সুবিধা হারিয়েছিলেন? পাপের ফলস্বরূপ যে ফেরদৌস হারাতে হয়, মানবজাতির সেখানে পুনঃপ্রবেশের সকল আশা কি তাহলে চিরতরে তিরোহিত হয়েছে? তার পবিত্রতা কি চিরকালের জন্য তার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে? না। কারণ, আল্লাহ্পাক হচ্ছেন মহব্বত। তাঁর মহব্বত রহমতের পারাবার। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। পাপিষ্ঠের মৃত্যুতে আল্লাহ্-পাক আনন্দিত হন না, কেননা অপার রহমতে তাঁর হৃদয় পরিপূর্ণ। তিনি ঈসা-কালেমাতুল্লাহ্‌র ব্যক্তিসত্তায় ধরা দেন মানবজাতির মহান ত্রাণকর্তা ও পাপক্ষয়কারী হয়ে, আর ঈসা মসীহ্ যিনি আল্লাহ্ পাকের কালাম তিনি তো প্রথমে আল্লাহ্‌র সঙ্গে ছিলেন। আল্লাহ্‌র মহব্বত প্রথম যে কাজটি করে, তা হচ্ছে হযরত আদম ও বিবি হাওয়ার নগ্ন তাকে ঢেকে দেওয়া, তাঁদের দেহে চামড়ার পোশাক পরিয়ে দেওয়া (পয়দায়েশ-খন্ড ৩:২১)। আর, এইভাবে, এই ব্যবস্থার মধ্যদিয়ে আল্লাহ্-পাক কাফফারার নীতিমালার সূচনা করেন।

ক্ষমা করো আমাদের ঋণের দেনা।আমরাও দেনাদারকে ক্ষমা করি।

ইসলামের দৃষ্টিতে কাফফারা

কাফফারার মাধ্যমে পাপমোচনের বিষয়ে কোরান শরীফে ১৪ টি আয়াত পাওয়া যায়। কোরান শরীফের সূরাহ্সমূহের মধ্যে পাপ মোচনের উপর আল্লাহ্‌র যে প্রথম কালামটি রয়েছে, তা হচ্ছে:

“তোমরা যদি প্রকাশ্যে দান কর, তবে উহা ভাল, আর যদি তাহা গোপনে কর এবং অভাবগ্রস্তকে দাও, তবে উহা তোমাদের জন্য আরও ভাল। এবং তিনি তোমাদের কিছু কিছু পাপ মোচন করেন:…..”

সূরা বাকারা ২৭১

ফক্বীহ্গণ কাফফারার মাধ্যমে যে পাপমোচন, তাকে আড়াল বা পর্দা হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এই ব্যাখ্যা নবীদের পুরাতন কিতাবে লিখিত বক্তব্যের কাছাকাছি যায়। সত্য বটে যে ইহুদী ধর্মের মতো ইসলামেও ব্যক্তিগত আমল বা কর্ম পাপমোচনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ সব কাজের মধ্যে সবচাইতে বেশি গুরুত্ব সালাতের (নামাযের-প্রার্থনার)। তাই বলা হয়েছে:

“সালাত কায়েম করিবে দিবসের দুই প্রান্তভাগে ও রজনীর প্রথমাংশে। সৎকর্ম অসৎকর্ম মিটাইয়া দেয়।”

সূরা হুদ ১১৪

তিরমিযী শরীফে রয়েছে, আবী, ‘আলিইয়ু বলেছেন:

“একজন স্ত্রীলোক আমার কাছে খেজুর কিনতে এল। আমি তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলাম। তাপর, মুহম্মদের কাছে গিয়ে,যা-কিছু ঘটেছে, সব তাঁকে বললাম। তিনি মাথা নীচু করে চিন্তায় মগ্ন হলেন; অনেক্ষণ পর বললেন, ‘সালাত কায়েম করিবে দিবসের দুই প্রান্তভাগে ও রজনীর প্রথমাংশে। সৎকর্ম ও অসৎকর্ম মিটাইয়া দেয়।’ এর অর্থ, পাঁচ ওয়াক্তের নামায পাপ ধুয়ে দেয় ও মোচন করে। তখন সাহাবীরা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে আল্লাহ্‌র রসূল এটা কি শুধু এই ব্যক্তির জন্য, না আমাদের সবার জন্যও?” তিনি বললেন, ‘সবার জন্য’।”

‘আব্দ্-আল্লাহ্‌র দেওয়া এই ঘটনার বর্ণনা উদ্ধৃত করে মুসলিম বলেছেন:

“এক ব্যক্তি নবীজীর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহ্‌র রসূল, শহরের বাইরে থেকে আসা একটি স্ত্রী লোককে আমি স্পর্শ করেছি আর আমার কাম-বাসনা চরিতার্থ করেছি যদিও সঙ্গম করিনি। আমি পাপ করেছি। এখন, যেমন খুশী, আপনি আমাকে শাস্তি দিন।’ ‘ উমর সেখানে উপস্থিত ছিলেন- বললেন,‘তুমি যদি ব্যাপারটা গোপন রাখতে, তাহলে তোমার এই গোপন কথা আল্লাহ্ই কেবল জানতেন।’ আল্লাহ্‌র রসূল কিছুই বললেন না। লোকটা চলে গেল। নবীজী আবার তাকে ডাকলেন এবং ‘সালাত করিবে।’ আয়াতটি তেলাওয়াত করলেন।”

আবু বকরের উদ্ধৃতি দিয়ে মুসলিম বলেছেন:

“আল্লাহ্‌র রসূলকে আমি বলতে শুনেছি, “আল্লাহ্‌র দাসদের মধ্যে কেউ হস্ত মুখাদি প্রক্ষালন করে (ওযু করে) দিগুণ নামায আদায় করলে আর আল্লাহ্‌র কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করলে আল্লাহ্ তাকে ক্ষমা করবেন না, এমন হতে পারে না।” নবীজী তারপর তেলাওয়াত করলেন : ‘যাহারা কোন অশ্লীল কার্য করিয়া ফেলিলে অথবা নিজেদের প্রতি জুলুম করিলে আল্লাহ্কে স্মরণ করে এবং নিজেদের প্রতি জুলুম করিলে আল্লাহ্কে স্মরণ করে এবং পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে, আল্লাহ্ ব্যতীত কে [ তাহাদের ] পাপ ক্ষমা করিবে? এবং তাহারা যাহা করিয়া ফেলে, জানিয়া শুনিয়া তাহাই করিতে থাকে না।’ (সূরা আল ইমরান-ইমরানের বংশধর: ১৩৫)

পাপমোচনের জন্য নেক আমল করা হলে তাতে যে সুফল পাওয়া যাবে সে ব্যাপারে সব চাইতে বেশি স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে কোরান শরীফের এই উক্তিতে:

“সেদিন ওজন ঠিক ভাবেই করা হইবে। যাহাদিগের পাল্লা ভারী হইবে, তাহারাই সফলকাম হইবে; আর যাহাদিগের পাল্লা হাল্কা হইবে, তাহারাই নিজদিগের ক্ষতি করিয়াছে যেহেতু তাহারা আমার নিদর্শনকে (আয়াতকে) প্রত্যাখ্যান করিত।”

সূরা আল-আ’রাফ ৮-৯)

আমল কীভাবে ওজন হবে, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ইমাম আ-রাযী দুটি জিনিসের উল্লেখ করেছেন:

প্রথমতঃ, আল্লাহ্ হাশরের দিন দাড়িপাল্লা স্থাপন করবেন তাতে একটি নিক্তি কাঁটা থাকবে আর দুদিকে দুটো ওজন-পাত্র। তাতে ওজন করা হবে মানুষের আমল- ভাল কাজ আর খারাপ কাজ।

ইবনে ‘ আব্বাসের বলে উল্লেখিত উক্তিতে রয়েছে:

“ঈমানদারের নেক আমল সুন্দর করে সযত্নে পাল্লায় রাখা হরে। তাঁর ভাল কাজ খারাপ কাজের চাইতে ভারী হবে।”

আমল কেমন করে ওজন করা হবে, তাই নিয়ে অনেক মত রয়েছে। তার মধ্যে একটা হচ্ছে যে, ঈমানদারদের নেক আমল একটা লেফাফায় করে নিয়ে আসা হবে এবং ঈমানহীনদের বদ আমল আনা হবে অন্য লেফাফায় করে। সেই দুই লেফাফা ওজন করা হবে। আর একমত হচ্ছে, মানুষের আমলের হিসাব যে কাগজে লেখা হয়েছে, সেই কাগজ ওজন করা হবে।

মুজাহিদ ও আয-যাহ্হাক ও আল-আ’মান-এর কাছ থেকে পাওয়া দ্বিতীয় উক্তি হচ্ছে: দাড়িপাল্লার উদ্দেশ্য হবে ন্যায়বিচার হাশরের দিন যে ওজন হবে, সে ব্যাপারে হযরত মুহম্মদকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, আমলনামা ওজন করা হবে।

দাড়িপাল্লার নিক্তিকাঁটার দৈর্ঘ্য আর ওজন-পাত্রের প্রশস্ততা সম্পর্কে বিশেষ একটা কাহিনী প্রচলিত আছে। ‘আব্দ্-আল্লাহ্ ইবনে সালাম বলেছেন: “দুই ওজনপাত্রের যে কোন একটাতে গোটা পৃথিবী আর আকাশমন্ডলীকে চাপানো হলেও স্থান সঙ্কুলানে কোন অসুবিধা হবে না। জিব্রাইল সেই দাড়িপাল্লার হাতল ধরে থাকলে তিনি তার নিক্তিকাঁটার দিকে নজর রাখতে পারবেন।”

ওজনের পদ্ধতী সম্পর্কে আব্দ্-আল্লাহ্ ইবনে বলেছেন: আল্লাহ্‌র রসূল বলেছেন, ‘হাশরের দিন লোককে দাড়িপাল্লার কাছে নিয়ে আসা হবে। আমলের ৯৯টি খাতা তাকে দেওয়া হবে। সেই সব খাতা তার চোখের সামনে মেলে ধরা হবে আর সে তার সবই দেখতে পারবে। সে তাতে দেখতে পাবে তার যত পাপ আর অরাধের বিবরণ। এই সব বিবরণ দাড়িপাল্লার একদিকে চাপানো হবে। তারপর, তার কাছে আনা হবে আঙুলের মাথার সমান ছোট্ট এক টুকরো কাগজ। তাতে লেখা থাকবে সেই লোকের স্বীকারোক্তি: “আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন মাবুদ নাই, মুহম্মদ তাঁর প্রেরিত রসূল।” কাগজের টুকরোটিকে চাপানো হবে দাড়িপাল্লার অন্যদিকে এবং সেই দিকটা পাপের দিকের চাইতে ভারী হবে।’”

আর, কোরান শরীফে ওজনের বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে এই ভাবে:

“এবং কিয়ামত-দিবসে আমি স্থাপন করিব ন্যায় বিচারের মানদন্ড। সূতরাং, কাহারও প্রতি কোন অবিচার করা হইবে না এবং কর্ম যদি তিল পরিমাণ ওজনেরও হয়, তবু উহা আমি উপস্থিত করিব। হিসাব গ্রহণকারীনূপে আমিই যথেষ্ট।”

সূরা আল-আম্বিয়া ৪৭)

তফসীরকারেরা বলেছেন যে, অন্তরের অভিপ্রায় মাপবার জন্য একটি, আর বাইরের আমল মাপবার জন্য আর-একটি দাড়িপাল্লা থাকবার সম্ভবনা রয়েছে।

আল-ফখ্র্ আর-রাযী একটি প্রচলিত কাহিনী বলেছেন, যা হচ্ছে এই রকম:

হযরত দাউদ তাঁর প্রতিপালককে সেই দাড়িপাল্লা দেখাতে বললেন। দেখা মাত্র তিনি মূর্ছা গেলেন। জ্ঞান ফিরে এসে তিনি বললেন, হে আল্লাহ্, কে এমন আছে, যে নেক কাজ দিয়ে এই এত বড় পাল্লা ভরাট করতে পারবে? আল্লাহ্ বললেন, হে দাউদ, আমার দাসের উপর যদি আমি সন্তুষ্ট থাকি, তাহলে আমিই তা নেক আঞ্জাম (সুফল) দিয়ে ভরাট করব।

হুদাইফার উদ্ধৃতি দিয়ে বিলাল বিন ইয়াহ্ইয়া বলেছেন:

“জিব্রাইল আলাইহিস্ সালাম হাশরের দিন দাড়িপাল্লার দায়িত্বে থাকবেন। আল্লাহ্ বলবেন, ‘হে জিব্রাইল, ওদের মধ্যে ওজন করো আর মজলুমের পাওনা চুকিয়ে দাও। জালেমের যদি কোন নেক কাজ না থাকে, তাহলে তার পাল্লায় মজলুমের পাটুকু চাপিয়ে দাও। তবেই জালেম বুঝতে পারবে, তার পাপের বোঝা কেমন পর্বতের মতো ভারী।’”

আবু জা’ফর বর্ণনা দিয়েছেন যে, মুহম্মদ বললেন, “দাড়িপাল্লায় চরিত্রের সততা যত ভারী হবে অন্য কোন কিছুই তত নয়।”

সর্বশেষ, ইবনে ‘আব্বাসের উদ্ধৃতি দিয়ে মুহম্মদ বিন সা’দ যে কথা বলেছেন, সেটাকে সমস্ত মন্তব্যের সারসংক্ষেপ বলা যায়। আর তা হচ্ছে:

“যে ব্যক্তি নেক আমল দিয়ে তার বদ কাজকে ঘিরে রাখতে পেরেছে, তার পাল্লা ভারী হবে অর্থাৎ তার ভাল কাজ খারাপ কাজকে হটিয়ে দেবে। আর, যার খারাপ কাজ নেক আমলকে ঘিরে রেখেছে, নিশ্চয় তার পাল্লা হালকা হবে অর্থাৎ সে জাহান্নামের সন্তান। তার খারাপ কাজ ভাল কাজকে হটিয়ে দেবে।”

ধার্মিকতা পাপ মোচন করে

আল্লাহ্-পাক বলেছেন:

“হে বিশ্বাসীগণ!যদি তোমরা আল্লাহ্কে ভয় কর, তবে আল্লাহ্ তোমাদিগকে ন্যায়-অন্যায় পার্থক্য করিবার শক্তি দিবেন, তোমাদিগের পাপমোচন করিবেন এবং তোমাদিগকে ক্ষমা করিবেন এবং আল্লাহ্ অতিশয় মঙ্গলময়।”

সূরা আল-আনফাল ২৯

আমরা এখানে লক্ষ্য করছি যে, আল্লাহ্কে ভয় করলে অর্থাৎ ধার্মিক হলে তার পুরষ্কার হবে ত্রিবিধ:-

  1. আল্লাহ্ আপনাকে ন্যায় অন্যয়ের তারতম্য করবার ক্ষমতা দেবেন।

    ইসলামী শরীয়তবিদ্গণ এর অর্থ করেছেন যে, কোনটা আল্লাহ্‌র পথ আর কোনটা নয়, সেইটা নিরূপণের ক্ষমতা লাভ করা যাবে। অর্থাৎ আল্লাহ্ আপনাকে সৎ নেতৃত্ব ও জ্ঞান দেবেন, আনন্দের প্রশান্তে দিয়ে আপনার মন-প্রাণ ভরে তুলবেন এবং অন্তঃকরণ থেকে বিদ্বেষ ও ঘৃণার বিষ মুছে ফেলবেন।

  2. আপনি যত খারাপ কাজ করেছেন, তেমন সমস্ত খারাপ কাজই আল্লাহ্ ঢেকে রাখবেন।
  3. তিনি আপনাকে ক্ষমা করবেন।

যারা ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত

ধার্মিকতার কারণে,

তারাই

আশিস্ ভাজন।

তারা পরিতৃপ্ত হবে।

ইসলামের দৃষ্টিতে ক্ষমা

কোরান শরীফের আয়াতসমূহ মনোযোগ দিয়ে অধ্যয়ন করলে দেখা যাবে যে,“কাফফারা” (প্রায়শ্চিত্ত) ও “ক্ষমার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। তফসীরকারেরা এই পার্থক্যের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন যে, কাফফারার মাধ্যমে পাপমোচন ইহজগৎ নিয়ে, আর ক্ষমার অর্থ হচ্ছে কেয়ামতের দিন পাপ মুছে যাওয়া।

আমল ও ক্ষমা

ইসলামের শিক্ষা-অনুযায়ী পাপের ক্ষমা নেক আমলের উপর নির্ভর করে। যেমন কোরান শরীফে রয়েছে:

“….যাহারা ভালর দ্বারা মন্দের মোকাবিলা করে, ইহাদিগের জন্যই শুভ পরিণাম-স্থায়ী জান্নাত। উহাতে তাহারা প্রবেশ করিবে এবং তাহাদিগের পিতা-মাতা, পতি-পত্নী ও সন্তান-সন্ততিদিগের মধ্যে যাহারা সৎকর্ম করিয়াছে, তাহারাও।”

সূরা রা’দ ২২-২৩

বর্ণনা করা হয়েছে যে, হযরত মুহম্মদ মু’আদ বিন জবলকে বললেন,

“তুমি যদি কোন অসৎকর্ম করে থাকো, তাহলে তার সঙ্গে একটা সৎকর্ম করো তাহলে তা মুছে যাবে।”

যারা সৎকর্ম করেছে, তাদের বর্ণনা দিতে গিয়ে আল-হাসানও বলেছেন,

“তারা নিজেরা যখন সাহায্য থেকে বঞ্চিত ছিলেন, তখন অন্যকে তাঁরা সে সাহায্য দিয়েছেন, আর তাঁদের প্রতি যখন অন্যায় করা হয়েছে, তখন তারা উৎফুল্ল থেকেছেন।”

যুজাজ বলেছেন,

“বংশগত মর্যাদার সঙ্গে যদি নেক আমল না থাকে, তাহলে সে মর্যাদা কোনই কাজে আসবে না।”

ইবনে ‘আব্বসের উদ্ধৃতি দিয়ে আল-ওয়াহিদি ও আল-বুখারী বলেছেন,

“অনুগত বান্দার পুরষ্কারের অংশ হিসাবে আল্লাহ্ তাকে বেহেশতে নিজের পরিজনবর্গকে সঙ্গে নিয়ে বসবাসের সুখভোগ করতে দেন।”

এর থেকে আভাস পাওয়া যায় যে, যাঁর নেক আমল আছে, তিনি অনুগত বান্দার সম্মান নিয়ে বেহেশতে প্রবেশ করবেন। যদি তিনি এই নেক আমলের কারণে বেহেশতে প্রবেশ করেন, তাহলে এতে অনুগত বান্দা হওয়ায় সম্মানের কিছু থাকছে না, কেননা যিনিই নেক আমল করেছেন, তিনিই তো বেহেস্তে যাবেন।

সিয়াম (রোযা) ও ক্ষমা

সূরা আল-আহ্যাব (গোত্রসমূহ)-এর ৩৪ আয়াতে আছে যে, সিয়াম-পালনকারী পুরুষ ও সিয়াম-পালনকারী নারীর জন্য আল্লাহ্ ক্ষমা ও মহা পুরষ্কারের ব্যবস্থা রেখেছেন।

কোরান শরীফে বলা হয়েছে যে, হত্যাজনিত পাপের ক্ষমা পাওয়া যাবে যদি অবিরাম দুইমাস-কাল রোযা রাখা যায়। এতে রয়েছে:

“কোন বিশ্বাসীকে হত্যা করা কোন বিশ্বাসীর জন্য সঙ্গত নহে, তবে ভুলবশতঃ করিলে উহা স্বতন্ত্র: এবং কেহ কোন বিশ্বাসীকে ভুলবশতঃ হত্যা করিলে এক বিশ্বাসী দাস মুক্ত করা এবং তাহার (নিহতের) পরিজনবর্গকে রক্তপণ অর্পণ করা বিধেয়, যদি না তাহারা (নিহতের পরিজনবর্গ) ক্ষমা করে। যদি সে (নিহত) তোমাদের শত্রু পক্ষের লোক হয় এবং বিশ্বাসী হয়, তবে এক বিশ্বাসী দাস মুক্ত করা বিধেয়। আর যদি সে এমন এক সম্প্রদায়ভুক্ত হয়, যাহার সহিত তোমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ, তবে তাহার পরিজনবর্গকে রক্তপণ অর্পণ এবং এক বিশ্বাসী দাস মুক্ত করা বিধেয়, এবং যে সঙ্গতিহীন, সে একাধিক্রমে দুইমাস সিয়াম পালন করিবে। তওবার জন্য ইহা আল্লাহ্‌র ব্যবস্থা এবং আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ প্রজ্ঞাময়।”

সূরা আন-নিসা-স্ত্রীলোকগণ: ৯২

আয়াতটি প্রদত্ত হবার কারণ সম্বন্ধে যে সব মত রয়েছে, তার কয়েকটি নিম্নরূপ:-

‘উরওয়া বিন আয-যুবাইর বলেছেন: ওহোদের যুদ্ধের দিন হুদাইফা ইবনে আল-ইয়ামান আল্লাহ্‌র রসূলের সঙ্গে ছিলেন। মুসলিমগণ আল-ইয়ামানের পিতাকে কাফের মনে করে তাঁকে ধরলেন এবং তাঁর উপর তরবারির আঘাত হানলেন যদিও হুদাইফা তখন বলেছিলেন, “তিনি আমার পিতা”। কিন্তু তাঁরা হয়তো তাঁর কথা বুঝতে পারেননি এবং ততক্ষণে হত্যার কাজ সাঙ্গ হয়েছে। তখন হুদাইফা বললেন, “আল্লাহ্ তোমাদের ক্ষমা করুন। তিনিই শ্রেষ্ঠ ক্ষমাশীল।” আল্লাহ্‌র রসূল যখন এ কথা শুনলেন, তাঁর দৃষ্টিতে হুদাইফার মর্যাদা অনেক বেড়ে গেল, আর তখন এই আয়াত দেওয়া হল।

আয়াতটির জন্য আরও একটা ঘটনার বিরণ রয়েছে। একদল যোদ্ধার সঙ্গে থাকবার কালে আবু আদ-দারদা কোন কারণে একটু দূরে গেলেন। কয়েকটি ভেড়া চড়ানো অবস্থায় একটা লোককে তিনি সেখানে দেখতে পেয়ে তার উপর তরবারি দিয়ে আক্রমণ করলেন। লোকটা বলল,-“লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্” “আল্লাহ্ ব্যতীত আর কোন মাবুদ নাই।” কিন্তু আবু আদ-দারদা তাকে মেরে ফেললেন আর তার ভেড়া গুলো নিয়ে চলে গেলেন। পরে তার অনুশোচনা হল এবং তিনি নবীজীকে ঘটনাটা জানালেন। নবীজী প্রশ্ন করলেন, “লোকটা অন্তরে মোমেন ছিল কিনা, সে ব্যাপারে তুমি কি কিছু জানতে পেরেছ?” আবু আদ-দারদা তখন অনুতাপ করলেন এবং তারপর এই আয়াত শোনা গেল।

কোরান শরীফে আরও রয়েছে যে, মিথ্যা শপথ জনিত গুনাহের ক্ষমা পেতে হলে তিনদিন রোযা রাখতে হবে। কোরান শরীফে লিখিত হয়েছেঃ

“তোমাদের নিরর্থক (অনিচ্ছাকৃত) শপথের জন্য আল্লাহ্ তোমাদিগকে দায়ী করিবেন না, কিন্তু যে সব শপথ তোমরা ইচ্ছাকৃতভাবে কর, সেই সকলেন জন্য তিনি তোমাদিগকে দায়ী করিবেন। অতঃপর ইহার প্রায়শ্চিত্ত (“কাফ্ফারাহ”): দশজন দরিদ্রকে মধ্যম ধরনের খাদ্যদান, যাহা তোমরা তোমাদের পরিজনদিগকে খাইতে দাও অথবা তাহাদিগকে বস্ত্র দান, কিংবা একজন দাস মুক্তি এবং যাহার সামর্থ নাই, তাহার জন্য তিনদিন সিয়াম পালন। তোমরা শপথ করিলে ইহাই তোমাদের শপথের প্রায়াশ্চিত্ত। তোমরা তোমাদের শপথ রক্ষা করিও। এইভাবে আল্লাহ্ তোমাদের জন্য তাঁহার নিদর্শন (আয়াত) বিশদভাবে বর্ণনা করেন যেন তোমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন কর।”

সূরা মায়িদাহ্ ৮৯

আল-ফখ্র্ আর-রাযী বলেছেন যে, যে কারণে আয়াতটি দেওয়া হয়, তা হচ্ছে: হযরত মুহম্মদের বেশ কিছু অনুসারী আহার, পোশাক পরিহার করে ফকীরী গ্রহণ করেন, আর শপথ নিয়ে তাঁরা তা করেন। তিনি যখন তাঁদেরকে তা করতে নিষেধ করে দেন, তখন তারা বললেন, “হে আল্লাহ্‌র রসূল, কিন্তু আমরা যে শপথ নিয়েছি- এখন আমরা কী করব?” তখন এই আয়াত দেওয়া হয়।

হজ্ পালন ও ক্ষমা

কোরান শরীফে বলা হয়েছে:

“সাফা ও মারওয়া [পর্বত] আল্লাহ্‌র নিদর্শনসমূহের (শা’আয়ির) অন্যতম। সুতরাং যে কেহ কাবাগৃহে হজ্ব কিংবা ওমরা সম্পন্ন করে, এই দুইটি প্রদক্ষিণ করিলেন তাহার কোন পাপ নাই, স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৎকার্য করিলে, আল্লাহ্ পুরস্কার দাতা, সর্বজ্ঞ।”

সূরা বাকারা ১৫৮

ইবনে আব্বাস বলেছেন:

“সাফা পর্বতে একটি ও মারওয়া পর্বতে একটি মূর্তি ছিল। জাহেল অবিশ্বাসীরা এই দুই জায়গায় সূর্তি দুটিকে তাওয়াফ করত ও স্পর্শ করত। ইসলামের আগমনের পর মুসলিমগণ এই ক্রিয়াকান্ড ও মূর্তি দুটির উপস্থিতিকে ঘৃণা করতে আরম্ভ করেন। সূতরাং আয়াতটি আসে।”

“তাহার কোন পাপ নাই।” কথাটার অর্থ, তার কোন অপরাধ নেওয়া হবে না আর স্বেচ্ছায় হজ্ব পালনকারীদের নেক কাজ আল্লাহ্ কবুল করবেন।

দান-খয়রাত ও ক্ষমা

কোরান শরীফে বলা হয়েছে:

“যাহারা….. সালাত কায়েম করে ও যাকাত দেয়, তাহাদের পুরষ্কার তাহাদের প্রতিপালকের নিকট আছে, এবং তাহাদের কোন ভয় নাই এবং তাহারা দুঃখিতও হইবে না।”

সুরা বাকারা ২৭৭

এর উপর মন্তব্য করতে গিয়ে ইবনে ’আব্বাস বলেছেন:

“কেয়ামতের দিনের পরিস্থিতিতে যে ভয়াবহতা অপেক্ষা করছে, তার জন্য তাদেরকে দুঃখ পেতে হবে না।”

আল-আস’আম ব্যাখ্যা দিয়েছেন:

“সেই মহা দিবসে তাদের কষ্টভোগের কোন ভয় থাকবে না, কিংবা তাদেরকে দুঃখও পেতে হবে না, কেননা ইহকালে অন্যেরা যেমন সুখভোগ করেছে, তারা তা করেনি; আর এই দুনিয়ায় যে রেষারেষি, প্রতিদ্বন্দ্বিতা ঐ দুনিয়ায় তার কোন অস্তিত্ব নেই।”

আল্লাহ্‌র পথে-উদ্যম ও ক্ষমা

কোরান শরীফে রয়েছে:

“যাহারা বিশ্বাস করে (ঈমান আনে) এবং যাহারা আল্লাহ্‌র পথে স্বদেশ ত্যাগ করে (হিজরত করে) ও জিহাদ করে (উদ্যমী হয়), তাহারাই আল্লাহের অনুগ্রহ প্রত্যাশা করে। আল্লাহ্ ক্ষমা পরায়ণ, পরম দয়ালু।”

সূরা বাকারা ২১৮

‘আবদ্-আল্লাহ্ বিন জাব্‌শ-এর বিবরণ অনুযায়ী:

তিনি হযরত মুহম্মদকে প্রশ্ন করলেন, “হে আল্লাহ্‌র রসূল, ধরুন, আমরা যে সব খারাপ কাজ করেছি, তার যদি কোন শাস্তি না থাকে, তাহলে আমাদের ভাল কাজের জন্য আমরা কি কোন পুরষ্কার আশা করতে পারি?” তখন আয়াতটি প্রদত্ত হয়, কেননা ’আবদ্-আল্লাহ্ হিজরত করেছিলেন এবং আল্লাহ্‌র পথে উদ্যমী হয়েছিলেন (জেহাদ করেছিলেন)।

কোরান তেলাওয়াত ও ক্ষমা

কোরান শরীফে বলা হয়েছে:

যখন কুরআন পাঠ করা হয়, তখন তোমরা মনোযোগের সহিত উহা শ্রবণ করিবে এবং নিশ্চুপ হইয়া থাকিবে, যাহাতে তোমাদিগের প্রতি দয়া করা হয়।”

সূরা আ’রাফ ২০৪

তফসীর কারেরা বলেছেন যে, এই আয়াতের আগেও আল্লাহ্-পাক তাঁর কিতাবকে জগতের জন্য রহমতস্বরূপ বলে অভিহিত করেছেন। হাদীস শরীফে রয়েছে যে,

আবু যার আল-গিফারী হযরত মুহম্মদকে বললেন, “হে আল্লাহ্‌র রসূল, কোরান শিখতে আমি ভয় পাই যদি তার শিক্ষা অনুযায়ী কাজ না করি।” হযরত মুহম্মদ বললেন, “হে আবু যার, ভয় পেয়ো না। যে অন্তঃকরনে কোরানের বসবাস, আল্লাহ্ সেই অন্তঃকরনকে উৎপীড়িত করেন না।”

আনাস ইবনে মালিকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে:

“রসূল আমার সঙ্গে কথা বলেছিলেন-তিনি বললেন, ‘ যে কোরান শোনে, জগতের যন্ত্রণা তার ধারে-কাছেও আসে না, আর যে নিজে কোরান তেলাওয়াত করে, আখেরাতের যন্ত্রণা থেকেও সে মুক্ত।’”

ইবনে মাস’উদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে,

“হযরত মুহম্মদ তাঁকে বললেন, যে ব্যক্তি কোরান তেলাওয়াত করে, হেফয করে আর তা মনে রাখে, আল্লাহ্ তাকে বেহেস্তে নিয়ে আসবেন এবং অবধারিত দোযখযাত্রী দশজনের পক্ষে তাকে সুপারিশ করবার অনুমতি দেওয়া হবে।”

আল্লাহ্-ও-রসূলের-পক্ষে-সাক্ষ্য ও ক্ষমা

আবু হুরাইরা বর্ণনা দিয়েছেন যে, আবু যার আল-গিফারী হযরত মুহম্মদের কাছে জানতে চাইলেন, “হে আল্লাহ্‌র রসূল, একজন মসলিম কীভাবে নাজাত লাভ করবে?” হযরত মুহম্মদ বললেন, “সে নাজাত পাবে যদি সে বলে:“আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই, তিনি এক, তাঁর কোন অংশীদার নেই এবং আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহম্মদ তাঁর দাস ও প্রেরিত।”

আল্লাহ্‌র-অভিপ্রায় ও ক্ষমা

কোরান শরীফে বলা হয়েছে:

“আসমান (আস্মানসমূহ) ও জমিনে যাহা কিছু আছে সমস্ত আল্লাহেরই। তিনি যাহাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন এবং যাহাকে ইচ্ছা শাস্তি দান করেন।…..”

সুরা আলে-‘ইমরান ১২৯

ফখ্‌র্‌ আর-রাযী এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন:

“আমাদের সহকর্মীরা আয়াতটির উপর এই অভিমত ব্যক্ত করে থাকেন যে, আল্লাহ্ যেহেতু সবার উপরে, সব-কিছুর ঊর্ধ্বে, সেহেতু নিজের বিচার ক্ষমতা প্রয়োগ করে সকল অবিশ্বাসী আর অবাধ্য-অনুগতকে বেহেস্তে নিয়ে আসবার এবং সকল ঈমানদারকে জাহান্নামে নিক্ষেপের অধিকার তাঁর রয়েছে; তিনি যদি তা করেন, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবার কোন সুযোগ নেই।”

এই ধরনের অভিমতে আর-রাযী আপত্তি করেন নি। তিনি বরং তা জোর সমর্থনই করেছেন এই বলে:

“আয়াতটি থেকে এই অর্থই স্পষ্ট হয়। বুদ্ধির দৃষ্টিতেও এ অর্থ সমর্থন লাভ করে। কারণ মানুষের কাজ আল্লাহ্‌রই অভিপ্রায়ের উপর নির্ভর করে, আর অভিপ্রায়ও আল্লাহ্‌রই সৃষ্টি।আল্লাহ্ যদি এমন অভিপ্রায় সৃষ্টি করেন, মানুষ যার প্রতি বাধ্য থাকে, তাহলে এবং তিনি যদি অন্য এমন আর-এক প্রকারের অভিপ্রায় সৃষ্টি করেন, মানুষ যার প্রতি অবাধ্য, তাহলে মানুষের সেই বাধ্যতা আর সেই অবাধ্যতা আল্লাহ্‌র কাছে একই। আল্লাহ্‌র কোন কাজই তাঁর নিজের বাধ্যতামূলক নয়। তাই মানুষের বাধ্যতা পুরষ্কারদায়ক হবেই, কিংবা অবাধ্যতা শাস্তি ডেকে আনবেই, এমন কোন কথা নেই। সব-কিছু আল্লাহ্‌র দিক থেকে আসে এবং সর কিছু ঘটে আল্লাহ্‌রই অভিপ্রায়ে, শাসন আর ক্ষমতার বলে।”

কিন্তু কিতাবুল মোকাদ্দসে এই মতের সমর্থন মেলে না। গুনাহের কাফফারা হিসাবে কোরবানির কথা তাতে জোর দিয়ে বলা হয়েছে। এই কোরবানি বাধ্যতামূলক সেই কোন্ সূচনাকাল থেকে, কেননা আমরা দেখতে পাই, কোরবানির রক্ত টকটকে রক্তিম সূতার মতো হয়ে কিতাবুল মোকাদ্দসের আরম্ভ হইতে শেষ পর্যন্ত প্রবাহিত। এই কিতাবে আমরা তাই পড়ি:

“রক্তপাত না হইলে পাপের ক্ষমা হয় না।”

ইঞ্জিল শরীফ, ইবরানী ৯:২২

বস্তুত, আল্লাহ্-পাকের অভিপ্রায় কখনও এমন হতে পারে না যে, তিনি অভ্রান্ত হওয়ায়, তিনি সত্য ন্যায়পরায়ণ হওয়ায় মানুষের পাপ ক্ষমা হয়ে যাবে। তাই বলা হয়েছে:

“যে প্রাণী পাপ করে, সেই মরিবে।”

কিতাবুল মোকাদ্দস, হিজকিল ১৮: ৪,২০

আল্লাহ্ যদি পাপীকে ক্ষমা করে দেন, তাহলে তার পেছনে এমন যুক্তি থাকতে হবে, যেন তাতে ন্যায়বিচারের চাহিদা পূর্ণ হয় এবং তৌরাত, জবুর ও নবীদের অন্যান্য কিতাবে সে চাহিদার পূর্ণতার বিধান রয়েছে ছাগল, গাভী, মেষ প্রভৃতি পশু-কোরবানির মাধ্যমে। এ কোরবানি ঈসা-কালেমাতুল্লার আত্ম-কোরবানির প্রতীকরূপ বলে আল্লাহ্ তা কবুল করেছেন। এই কোরবানির মহিমান্বিত ইঞ্জিল শরীফে বাস্তব রূপ লাভ করেছে, যার দ্বারা আল্লাহ্‌র শাশ্বত ইনসাফের চাহিদা পূর্ণ হয়েছে, যা সকল ঈমানদারকে খাঁটি করেছে এবং যার দ্বারা পূর্ণ হয়েছে জবুর শরীফে লিপিবদ্ধ এই বাণী:

“সত্য ও দয়া (হক ও রহমত) পরস্পর মিলিল, দ্বীনদারী ও সালামতী পরস্পর চুম্বন করিল।”

জবুর শরীফ ৮৫:১০

ইসলামের দৃষ্টিতে ক্ষমাহীন পাপসমূহ

১। আল্লাহ্‌র শরীক করা ক্ষমাহীন:

কোরান শরীফে রয়েছে:

“আল্লাহ্‌র শরীক করার অপরাধ তিনি ক্ষমা করেন না, ইহা ব্যতীত সব কিছু যাহাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন এবং কেহ আল্লাহের শরীক করিলে সে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট হয়।”

সূরা আন-নিসা ১১৬

তফসীরকারেরা বলেছেন যে, বহু আল্লাহে বিশ্বাসী ব্যক্তি আল্লাহ্‌র রহমত থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত,কেননা বহু আল্লাহ্‌রবাদ মহা কুফ্‌র।

কেউ কেউ বলেন, যারা ফেরেশতাদের পূজা করত এবং তাঁদেরকে আল্লাহ্‌র কন্যা বলে মনে করত, তাদের কারণে আয়াতটি আসে।

রাযী বলেছেন, যারা আখেরাতের জীবনে বিশ্বাস করে না, তারা ফেরেশতাদেরকে স্ত্রী হিসাবে বিবেচনা করে।

অন্যান্য তফসীরকারের মতে,যারা মূর্তি পূজা করত এবং বিশ্বাস করত যে,প্রত্যেক মূর্তির ভিতর একটা করে দৈত্য রয়েছে, যারা তাদের সঙ্গে কথা বলে, তাদের কারণে এই আয়াত দেওয়া হয়।

২। মোমিনকে হত্যা ক্ষমাহীন

কোরান শরীফে বলা হয়েছে:

“কেহ ইচ্ছাকৃতভাবে কোন বিশ্বাসীকে (মোমিনকে) হত্যা করিলে তাহার শাস্তি জাহান্নাম; সেখানে সে স্থায়ী হইবে এবং আল্লাহ্ তাহার প্রতি রূষ্ট হইবেন, তাহাকে অভিসম্পাত করিবেন, এবং তাহার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত রাখবেন।”

সূরা আন-নিসা ৯৩

আবু হুনাইফা বলেছেন, “ইচ্ছাকৃত হত্যার কোন ক্ষমা নাই।”

ইবনে ’আব্বাস বলেছেন, “যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করে, তার তওবা কবুল হয় না।”

৩। দ্বীন ত্যাগ-ক্ষমাহীন

কোরান শরীফে বলা হয়েছে:

“বিশ্বাস করার পর (ঈমান আনার পর) যাহারা সত্য প্রত্যাখ্যান করে এবং যাহাদের সত্য প্রত্যাখ্যানের প্রবৃত্তি বৃদ্ধি পাইতে থাকে, তাহাদের তওবা কখনও কবুল করা হইবে না। ইহারাই তাহারা, যাহারা পথভ্রষ্ট।”

সূরা আলে-‘ইমরান ৯০

তফসীরকারেরা বলেছেন যে, দ্বীন ত্যাগকারী ব্যতিত তার ঈমানহীনতাকে বহুগুণে বৃদ্ধি করে। অন্য কথায়, সে যে কেবল ঈমানহীন থাকছে তাই নয়-ঈমানহীনতাকে সে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। অর্থাৎ সে তার অবিশ্বাসের সঙ্গে যোগ করছে অবাধ্যতা।

আল-ক্বাফফাল ও ইবনে আল আমবারী বলেছেন, “একবার তওবা করে যে ব্যক্তি ঈমান এনেছে, সে ঈমান ত্যাগ করলে তার সেই তওবা বাতিল হয়ে যায়-যেন কখনও সে তওবা করেনি।”

মসীহীয়াতে কাফফারা

“কাফফারা” শব্দের অর্থ ঢেকে দেওয়া বা লুকিয়ে ফেলা। মসীহীয়াতে এর বিশেষ অর্থ হচ্ছে ঈসা-কালেমাতুল্লাহ্‌র কাজ। তিনি তাঁর সঠিক আনুগত্য দিয়ে সলিবে কোরবানির মাধ্যমে শরীয়তের অভিশাপ থেকে মানুষকে নাজাত দিয়েছেন এবং আল্লাহ্-পাকের সঙ্গে পুনর্মিলিত করেছেন। এই প্রসঙ্গে হযরত পিতর বলেছেন:

“মসীহ্ পাপের জন্য একবারই মরিয়াছিলেন। খোদার নিকট আমাদের লইয়া যাইবার জন্য, সেই নির্দোষ লোকটি পাপীদের জন্য অর্থাৎ আমাদের জন্য মরিয়াছিলেন।”

ইঞ্জিল শরীফ, ১ পিতর ৩: ১৮

ঈসা-কালেমাতুল্লাহ্ যে আল্লাহ্‌র চিরন্তন পুত্র, এই সত্যের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত তাঁর কাফফারার মূল্য।

বিভিন্ন দৃষ্টি কোন থেকে ঈসা-মসীহের কাফফারার বিষয়টি অবলোকন করা যেতে পারে। প্রথম, আল্লাহ্‌র মহব্বত, ইনসাফ ও পবিত্রতার প্রসঙ্গে তাঁর সঙ্গে কাফফারার সম্পর্ক এবং দ্বিতীয়, মানুষের কাজ ও মানুষের জন্য কাজ প্রসঙ্গে মানুষের সঙ্গে কাফফারার সম্পর্ক।

বলা হয়ে থাকে যে, মসীহীয়াতে কাফফারা হচ্ছে মানুষের পাপের প্রায়শ্চিত্ত। শরীয়তের অভিশাপ থেকে পাপীকে নাজাত দেবার জন্য আর তার লাঞ্ছনা দূর করবার জন্য ঈসা-কালেমাতুল্লাহ্‌র কোরবানি যে ফলপ্রসূ ছিল, মসীহী কাফফারা হচ্ছে তারই ঘোষণা। আরও বলা হয়ে থাকে যে, ঈসা কালেমাতুল্লাহ্‌র কাফফারা ছিল আল্লাহ্‌র তুষ্টির জন্য, তাঁর ইনসাফের পূর্ণতার জন্য অর্থাৎ আল্লাহ্‌র সন্তোষ আর প্রসন্নতার উপায় হিসাবে তা কাজ করেছে। পাপীর জন্য সুপারিশ গ্রহণ করতে গিয়ে আল্লাহ্-পাক যাতে শান্ত হন, তাঁর ক্রোধের গজব যাতে প্রশমিত হয়, সেজন্য ঈসা-মসীহের কোরবানির আকারে এই কাফফারা হচ্ছে ফলপ্রসূ একটা বহিঃপ্রকাশ।

আরও বলা হয়েছে যে, ঈসা-কালেমাতুল্লাহ্‌র রক্তের আকারে এই কাফফারা হচ্ছে পাপীর জন্য আবরণস্বরূপ। তার কাছ থেকে আর প্রায়শ্চিত্ত চাওয়ার থাকে না। পাপীর সব পাপ মসীহ্ নিজের উপর নিলেন, পাপীর জন্য তিনি নিজে কোরবানি হলেন। হযরত ইউহোন্না কথাটাকে তুলে ধরেছেন এইভাবে:

“আমরা যে খোদাকে মহব্বত করেয়াছিলাম তাহা নয়, কিন্তু তিনিই আমাদের মহব্বত করিয়া তাঁহার পুত্রকে (রূহানী-অর্থে) পাঠাইয়া দিয়াছিলেন, যেন পাপের দরুন আমাদের উপর খোদার যে দাবী-দাওয়া ছিল, পুত্র (রূহানী-অর্থে) তাঁহার নিজের মৃত্যু দ্বারা তাহা পূরণ করেন।”

ইঞ্জিল শরীফ, ১ ইউহোন্না ৪: ১০

আরও বলা হয়েছে, আল্লাহ্‌র শরীয়তের প্রতি কোনরূপ অশ্রদ্ধা প্রদর্শন ছাড়াই এই কাফফারা আল্লাহ্-পাক ও মানুষের মধ্যে সুপারিশের দরজা খুলে দিয়েছে। হযরত পৌল তাই বলেছেন:

“….খোদা মানুষের পাপ না ধরিয়া মসীহের মধ্য দিয়া নিজের সংগে মানুষকে মিলিত করিতেছিলেন। আর সেই মিলনের খবর জানাইবার ভার তিনি আমাদের উপর দিয়াছেন।”

ইঞ্জিল শরীফ, ২ করিন্থীয় ৫: ১৯

আল্লাহ্-পাকের প্রকৃতি এবং তাঁর সৃষ্ট পাপী জীব সমূহের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ককে নিয়ে মানুষ অনেক অনেক দর্শন সৃষ্টি করেছে কিন্তু এ ব্যাপারে কখনও গোটা একটা সন্তোষজনক সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। তবে দুনিয়ার দর্শনসমূহ যা ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হয়েছে, কিতাবুল মোকাদ্দসে তা প্রাঞ্জল করে দেওয়া হয়েছে। ইঞ্জিল শরীফে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ্ সঠিক ইনসাফই করেন এবং তার ইনসাফ হচ্ছে যে, পাপীকে শাস্তি পেতে হবে। কাজেই কাফফারা ছাড়া কোন সুপাবিশ চলতে পারে না। পাপ ঢাকবার জন্য কোরবারি যে ব্যবস্থা, তার সূচনা এই সত্য থেকেই। প্রথম মানব-মানবী আদম-হাওয়ার সময়ই ফেরদৌসে তা শুরু হয় আল্লাহ্ পাক যখন তাঁদের লজ্জা ঢাকবার জন্য চামড়ার আচ্ছদন তৈরি করে দেন, আর সেজন্যও পশু-কোরবানির প্রয়োজন হয়, যাতে কোরবানি হয়ে যাওয়া পশুর চামড়া সংগ্রহ করে সেই লজ্জা ঢেকে দেওয়া যায়।

কিতাবুল মোকাদ্দস থেকে আমরা জানতে পারি যে, হাবিলের দেওয়া যে কোরবানি আল্লাহ্-পাক কবুল করেন, তা ছিল প্রত্যাসন্ন খোদাবন্দের ছায়া কিন্তু সেই কোরবানি ছিল আশ্চর্যজনক প্রকাশ ও অনুপ্রেরণা (তৌরাত শরীফ, পয়দায়েশ ৪: ৪)।

ঠিক একইভাবে ইব্রাহিমের পুত্র ইস্হাক্কে কোরবানগাহ থেকে মুক্ত করবার উদ্দেশ্যে তাঁর কাছে আল্লাহ্-পাক যে মেষ পাঠিয়ে দেন, সেও ছিল মসীহের কোরবানির মাধ্যমে এক ধরনের কাফফারা, যার পরিকল্পনা আল্লাহ্-পাক শুরু থেকেই করে রেখেছিলেন। (তৌরাত শরীফ, পয়দায়েশ ২২: ১-১৪)।

তৌরাত শরীফের বিবরণ অনুযায়ী, মিসরে বনী-ইস্রাইলকে যে মেষ শাবক কোরবানির আদেশ আল্লাহ্-পাক দিয়েছিলেন (হিজরত-খন্ড ১২: ১-৪২, তা-ও ইঞ্জিল শরীফে বর্ণিত আল্লাহ্‌র মেষ-শাবককে (অর্থাৎ ঈসা কালেমাতুল্লাহ্কে) কোরবানি দেওয়ারই বিশিষ্ট একটা ধরন, হযরত পৌল যা এইভাবে উল্লেখ করেছেন:

“মেষ-শিশু মসীহ্কে কোরবানি দেওয়া হইয়াছে। সেইজন্য পুরাতন খামির অর্থাৎ হিংসা ও খারাপী দিয়া নয় বরং আস, আমরা খামিরহীন রুটি অর্থাৎ সরলতা ও সত্য দিয়া এই ঈদ পালন করি।”

ইঞ্জিল শরীফ, ১ করিন্থীয় ৫: ৭-৮

ইঞ্জিল শরীফে কোরবানির মাধ্যমে কাফফারাকে দেখানো হয়েছে পাপমোচনের উপায় হিসাবে, ঈসা-কালেমাতুল্লাহ্ যা চরিতার্থ করেন সলিবের উপর, যেন পাপী মানুষের জায়গায় আল্লাহ্‌র শরীয়তের চাহিদা আর মানুষের নাজাতের চাহিদা পূর্ণ হয়ে যায়। তাঁর কষ্টভোগের মধ্যে এবং পরিপূরক (বদলি) মৃত্যুর মধ্যে কাফফারার অর্থ নিহিত, যেন মানুষের পাপের জন্য তার প্রাপ্য শাস্তিটা সম্পূর্ণ হয়। আল্লাহ্-পাকের ইনসাফের চাহিদা এতে যেমন পূর্ণতা লাভ করে, তেমনি যে পাপী ঈমান এনেছে আর তওবা করেছে, এর দ্বারা তার তওবাও কবুল হয়ে যায়।

কিতাবুল মোকাদ্দসের ভাষায় ঈসা-মসীহের পাপ ক্ষয়ের জন্য দেওয়া কোরবানিকে “রহমত” বলে প্রকাশ করা হয়েছে। কারণ, আসমানী পিতা পাপী মানুষের জন্য কোরবানির ব্যবস্থা করতে বাধ্য ছিলেন না কিংবা পুত্রও বাধ্য ছিলেন না নিজে কোরবানি হবার জন্য মানুষের আকৃতি ধারণ করতে। কিন্তু আল্লাহ্-পাক তাঁর মহান ভালবাসার কারণে অনন্ত রহমতে সমৃদ্ধ, তাই পাপী মানুষের জায়গায় মানবরূপে আবির্ভূত আল্লাহ্‌র কালাম (অর্থাৎ ঈসা-কালেমাতুল্লাহ্) স্বেচ্ছায় বদলি (পরিপূরক) কষ্টভোগ কবুল করায় আল্লাহ্-পাক শরীয়তের শাস্তির অবসান ঘটান।

এই সত্যকেই কোরবানি- দানকারী ঈসা-রূহুল্লাহ্ প্রতিষ্ঠিত করেন যখন তিনি বলেন:

“আমি আমার ভেড়াগুলির জন্য প্রাণ দিব।”

ইঞ্জিল শরীফ, ইউহোন্না ১০: ১৫)

এই উক্তির সঙ্গে আমরা তুলনা করতে পারি ইউহোন্নার (১৫: ১৩) এই উক্তির যে, “কেহ যদি তাহার বন্ধুদের জন্য নিজের প্রাণ দেয়, তবে তাহার চেয়ে বেশি মহব্বত আর কাহারও নাই।” এবং বুঝতে পারি, কী উদ্দেশ্যে আল্লাহ্-পাক নিজেকে খালি করতে, রক্তমাংসের মানুষ হতে, কষ্টভোগ করতে আর সলিবের উপর নিজের দেহে আমাদের পাপ বহন করতে প্রস্তুত হয়েছিলেন।

এই যে বদলি-কষ্টভোগ, এর প্রয়োজনের কথা হযরত পৌল রোমীয়দের কাছে লেখা চিঠিতে স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন:

“…শরীয়ত যাহা করিতে পারে নাই, খোদা নিজে তাহা করিয়াছেন। তিনি পাপ দূর করিবার জন্য নিজের পুত্রকে (রূহানী অর্থে) একজন মানুষ করিয়া পাপী মানুষের চেহারায় পাঠাইয়া দিলেন, আর তাহা করিয়া মানুষের স্বভাবের মধ্যে যে পাপ আছে, সেই পাপের বিচার করিয়া তাহার শক্তিকে বাতিল করিয়া দিলেন। তিনি তাহা করিলেন যেন পাপ-স্বভাবের অধীন না চলিয়া পাক-রূহের অধীন চলিবার দরুন আমাদের মধ্যে শরীয়তের দাবী-দাওয়া পূর্ণ হয়।”

ইঞ্জিল শরীফ, রোমীয় ৮:৩-৪

এর অর্থ পাপের যে মজুরী তা হচ্ছে চিরন্তন মৃত্যু, ঈসা-কালেমাতুল্লাহ্ সেই মৃত্যু নিজের উপর গ্রহণ করেন এবং ইশায়া-নবীর এই ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণতা লাভ করে:

“…আমাদের শান্তিজনক শাস্তি তাঁহার উপর বর্তিল এবং তাঁহার ক্ষত সকল দ্বারা আমাদের আরোগ্য হইল।”

কিতাবুল মোকাদ্দস, ইশাইয়া ৫৩:৫

কাফফারার মাধ্যমে ক্ষমার নিশ্চয়তা পাওয়া যায় এবং আল্লাহ্‌তে বিশ্বাসী মানুষের নাজাতের জন্য তা আশীর্বাদ বয়ে আনে, আর তা হয়ে থাকে দ্বিবিধ কারণে:-

প্রথমতঃ,ঈসা-কালেমাতুল্লাহ্‌র বাধ্যতা ও কষ্টভোগের ভিত্তিতে আল্লাহ্-পাক ঈমানদারদের গুনাহ্ মাফ করে দেওয়ার ওয়াদা করেছিলেন। হযরত পৌল বলেছেন:

“তাহা হইলে একটা পাপের মধ্য দিয়া যেমন সমস্ত মানুষকেই আযাব পাইবার যোগ্য বলিয়া ধরা হইয়াছে, তেমনই একটা ন্যায্য কাজের মধ্য দিয়া সমস্ত মানুষকেই নির্দোষ বলিয়া গ্রহণ করিবার ব্যবস্থাও করা হইয়াছে এবং তাহার ফল হইল অনন্ত জীবন। যেমন একজন মানুষের (আদমের) অবাধ্যতার মধ্য দিয়া অনেকেই পাপী হইয়াছিল, তেমনই একজন মানুষের (ঈসা-মসীহের) বাধ্যতার মধ্য দিয়া অনেককেই নির্দোষ বলিয়া গ্রহণ করা হইবে।”

রোমীয় ৫:১৮-১৯

দ্বিতীয়তঃ, কাফফারার এই নীতি আল্লাহ্-পাকের ইনসাফের চাহিদা পূর্ণ করেছে, কেননা পিতা ও পুত্রের মধ্যকার চিরন্তরন চুক্তির ভিত্তির উপর এই ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত। এই সত্য সম্পর্কে কারও মনে যদি কোন সন্দেহ থাকে, তাহলে সে সন্দেহ দূর করবার জন্য আসমানী কালাম আমাদের কাছে রয়েছে, যাতে বলা হয়েছে:

“মসীহ্ এই দুনিয়াতে আসিবার সময় খোদাকে বলিয়াছিলেন, ‘পশু কোরবানী ও অন্যান্য কোরবানী তুমি চাও নাই কিন্তু আমার জন্য একটা দেহ তুমি তৈরি করিয়াছ। বেদীর (কোরবানগাহের) উপর পশু-পোড়ান কোরবানিতে এবং পাপের জন্য কোরবানিতে তুমি সন্তুষ্ট হও নাই। পরে আমি বলিলাম, পাক-কিতাবে আমার বিষয়ে যেমন লেখা আছে, হে খোদা, দেখ, আমি সেইভাবেই তোমার ইচ্ছা পালন করিতে আসিয়াছি।’”

জবুর শরীফ ৪০: ৬-৭ ও ইবরানী ১০:৫-৭

সুতরাং, ঈসা-কালেমাতুল্লাহ্ পাপীর বিকল্প (বদলি) হবার জন্য আর মৃত্যুর শাস্তি ভোগ করবার জন্য মানুষের রূপ গ্রহণ করলেন। চুক্তি লঙ্ঘিত হওয়ায় লঙ্ঘনকারী পাপী মানুষের যা প্রাপ্য ছিল, তিনি তা নিজের উপর নিলেন।

হযরত পৌল এই বিষয় ব্যাখ্যা করে বলেছেন:

“কিন্তু খোদা যে আমাদের মহব্বত করেন, তাহার প্রমাণ এই যে, আমরা পাপী থাকিতেই মসীহ্ আমাদের জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন। তাহা হইলে মসীহের রক্ত-দ্বারা যখন আমাদের নির্দোষ বলিয়া গ্রহণ করা হইয়াছে, তখন আমরা মসীহের মধ্য দিয়াই খোদার গজব হইতে নিশ্চয় রেহাই পাইব।”

রোমীয় ৫: ৮-৯

কাফফারার মাধ্যমে পাপক্ষয়ের প্রয়োজনের পক্ষে যুক্তিসমূহ

১। নাজাতের চাহিদা

পাপক্ষয় বা দায়মোচন কেবল যৌথ চাহিদা নয় বরং তা প্রত্যেক ব্যক্তির ব্যকিতগত চাহিদাও বটে। প্রত্যেক মানুষের দন্ডিত হওয়া ও ধ্বংস হওয়া অবধারিত। ঈসা-কালেমাতুল্লাহ্ একবার প্রশ্ন করেছিলেন:

“যদি কেহ সমস্ত দুনিয়া লাভ করিয়া তাহার সত্যিকারের জীবন হারায়, তবে তাহার কী লাভ? সত্যিকারের জীবন ফিরিয়া পাইবার জন্য তাহার দিবার মত কী আছে?”

ইঞ্জিল শরীফ, মথি ১৬: ২৬

মানুষের কাছে এমন কিছুই নাই, যা দিয়ে সে তার নিজের বা তার কোন ভাইয়ের পাপ ক্ষয় করতে পারে, আত্মকে শান্তি দিতে পারে। আল্লাহ্ পাক দাউদ-নবীর মাধ্যমে বলেছেন:

“তাহাদের মধ্যে কেহই কোন মতে ভ্রাতাকে মুক্ত করিতে পারে না কিংবা তাহার কাফফারার জন্য আল্লাহ্কে কিছু দিতে পারে না।”

জবুর শরীফ ৪৯: ৭

অন্যদিকে তওবা বা অনুতাপের ব্যাপারে বলা যায়, মানুষের মনে স্বাভাবিক একটা স্বজ্ঞাত সচেতনতা থাকে যে, তওবা দিয়ে কখনও অতীতের পাপ মুছে ফেলা যায় না। তাহলে মাফ পাবার নিশ্চয় অন্য কোন পথ আছে, আর তা হচ্ছে কাফফারার মাধ্যমে পাপক্ষয়। অন্যথায়, স্মরণাতীত কাল থেকে যে কোরবানির প্রথা চলে আসছে আর বিশ্বের অধিকাংশ ধর্মের মধ্যে যে সেই প্রথার প্রচলন লক্ষ্য করা যায়, তার ব্যাখ্যা কী হবে? তার অর্থ এই নয় কি যে, পাপী মনে প্রাণে কাফফারার প্রয়োজন অনুভব করে থাকে? সত্য হচ্ছে যে, আমাদের নৈতিক স্বভাব পবিত্রতার দাবিকে সম্মান করতে শেখায়- এমন কি আমরা নিজেদের আচরণের মাধ্যমে তার বিরোধিতা করলেও আমরা সবাই অনুভব করি যে, পূর্বের পাপের ফলভোগ থেকে নাজাতলাভের উপায় নিয়ে আমাদের মধ্যে দুশ্চিন্তা রয়েছে। কাফফারার মাধ্যমে পাপক্ষয়ের যে ইনসাফ, একমাত্র তার দ্বারাই সে নাজাত সম্ভবপর হতে পারে।

২। মানুষের অধঃপতন: আল্লাহ্‌র পবিত্রতা

আল্লাহ্ পবিত্র, মানুষ পাপী। মানুষের পাপাচারের অবস্থান আল্লাহ্‌র পবিত্রতার ঠিক বিপরীতে। সুতরাং মানুষ ধিক্কৃত, আর এই ধিক্কার তুলে না নেওয়া পর্যন্ত তার মাফ নেই। তওবার মাধ্যমে যদি নতুন করে নিষ্পাপ জীবন লাভ সম্ভবও হয়, তবু তার সেই নিষ্পাপিতা অতীতের পাপ মুছে ফেলবে কেমন করে। আর আল্লাহ্-পাক যদি কাফফারা ছাড়াই মাফ করে দেন, তাহলে তো আল্লাহ্‌র শরীয়তের প্রতি কিংবা তাঁর পবিত্রতার প্রতি পাপীর কোন শ্রদ্ধা থাকবে না। সেইজন্যই এসেছে কাফফারার বিধান যেন পাপের লাঞ্ছনা দূর করা যায় এবং আল্লাহ-পাকের চূড়ান্ত নিস্কলঙ্ক মহিমা উদ্ভাসিত হয়।

৩। কাফফারা মানুষের নৈতিক চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ

মানুষের একটা নৈতিক স্বভাব রয়েছে। বিবেক তাকে ন্যায় আর পবিত্রতার শ্রেষ্ঠত্ব শিক্ষা দেয়। সে যদি পাপের দায়ে দোষী হয় আর কাফফারার মাধ্যমে পাপক্ষয়ের কিছুই তার জানা না থাকে, তাহলে তার বিবেক অশান্ত থাকবে, সে মর্মপীড়া অনুভব করবে। অথচ কাফফারার মাধ্যমে ক্ষমা পেয়ে তার বিবেক তৃপ্তি বোধ করবে আর তার নৈতিক চাহিদাও পাবে পূর্ণতা।

৪। কাফফারা শরীয়তের চাহিদা পূর্ণ করে

শরীয়তের বিধান পাপীর শাস্তি দাবি করে। কোন আইনে শাস্তির ব্যবস্থা না থাকলে সে আইন প্রয়োগ যোগ্য নয়। স্বতঃসিদ্ধ যে, সম্মানজনক আইন অবশ্যই অপরাধীর শাস্তি বিধান করবে। কেবল অথর্ব, ভেঙ্গে-পড়া কোন আইনেই কাফফারা ছাড়া অপরাধীকে ক্ষমা করবার বিধান থাকতে পারে। আর তা হবে ঈসা-কালেমাতুল্লাহ্‌র এই কথার বিরোধিতা যে:

“আমি তোমাদের সত্যই বলিতেছি, আসমান ও জমিন শেষ না হওয়া পর্যন্ত, যতদিন না শরীয়তের সমস্ত কথা সফল হয়, ততদিন সেই শরীয়তের এক বিন্দু কি একমাত্রা মুছিয়া যাইবে না।”

ইঞ্জিল শরীফ, মথি ৫:১৮

অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, কাফফারা ছাড়া ক্ষমার কথা বলবার অর্থ হবে এমন কথা বলা যে, পাপীর শাস্তির কোন প্রয়োজন নেই, এবং তা হবে আল্লাহ্‌র ইনসাফ আর পবিত্রতার অবমাননা।

৫। আল্লাহ্‌র পাক-কালামে কাফফারার বিধান

কাফফারার যদি কোন প্রয়োজনই না থাকত, তাহলে আল্লাহ্-পাক তাঁর পাক কালামে তা অন্তর্ভূক্ত করতেন না। ঈসা-কালেমাতুল্লাহ্ বলেছেন:

“মূসা যেমন মরু-এলাকায় সেই সাপকে উঁচুতে তুুলিয়াছিলেন, তেমনই মনুষ্য পুত্রকেও উঁচুতে তুলিতে হইবে, যেন যে কেহ তাঁহার উপর ঈমান আনে, সে অনন্ত জীবন পায়”

ইঞ্জিল শরীফ, ইউহোন্না ৩:১৪-১৫

৬। নৈতিক বিধানের চাহিদা

আল্লাহ্-পাক নৈতিক বিচারক হওয়ায় তিনি নিশ্চয় বিচারের নিজস্ব বিধান পালন করবেন। যে নৈতিকতার জগতের ইপর তাঁর আধিপত্য, সেখানে অবাধ্যতা আর বিশৃঙ্খলার কোন অনুমতি থাকতে পারে না। তাঁর নির্দেশমালা ভঙ্গ করা হলে তিনি সেটাকে হালকাভাবে দেখতে পারেন না, বরং ভঙ্গকারীকে তিনি অবশ্যই জবাবদিহি করতে বলবেন এবং শাস্তি দেবেন। বস্তুতঃ, কাফফারার ব্যবস্থা করে তিনি পাপের প্রতি নিজের ঘৃণা আর কদাচারের প্রতি নিজের ক্রোধ ব্যক্ত করেছেন। অন্যদিকে তাঁর শরীয়ত মান্য করলে পাপীর জন্য তিনি আপোষের দরজা খুলে দিয়েছেন।

৭। বহু ধর্মে কাফফারার অস্তিত্ব রয়েছে

বহু ধর্মে কাফফারার যে ব্যবস্থা রয়েছে, তার থেকে বোঝা যায় যে, সমগ্র মানুষের বিবেক কাফফারা দিতে চায় এবং সে বিবেক পাপের জন্য কেবল তওবায় সন্তুষ্ট নয়। মানুষ পাপমোচন চায়, আর তা সম্ভব পাপীর রক্ত-ঝরানো কোরবানির মাধ্যমে।

এই সমস্ত যুক্তিই কাফফারার চাহিদা প্রমাণ করে।

নেক কাজ ক্ষমা

১। সৎকর্ম করা নৈতিক দায়িত্ব এবং অবশ্যই তা করতে হবে। কিন্তু সৎকর্ম করা হয়েছে বলে তা অতীতেরা অসৎকর্মের ক্ষতিপূরণ হতে পারে না, কখনও অতীত পাপের ক্ষমার উপায় বলে বিবেচিত হতে পারে না। ঈসা-কালেমাতুল্লাহ্ এই সত্যই ব্যক্ত করেছেন পর তোমরা বলিও,

‘আমরা অপদার্থ গোলাম। যাহা করা উচিৎ আমরা কেবল তাহাই করিয়াছি।’”

ইঞ্জিল শরীফ, লূক ১৭: ১০

আর হযরত পৌল বলেছেন:

খোদার রহমতে ঈমান আনিবার মধ্য দিয়া তোমরা পাপ হইতে উদ্ধার পাইয়াছ। ইহা তোমাদের নিজেদের দ্বারা হয় নাই, ইহা খোদারই দান। ইহা কাজের ফল হিসাবে দেওয়া হয় নাই, যেন কেহ গর্ব করিতে না পারে।”

ইঞ্জিল শরীফ, ইফিষীয় ২: ৮-৯

২। আমাদের যে সম্পত্তি আছে আর আমরা যে দেহ-মন স্বাস্থ্যের অধিকারী, তার সবই আল্লাহ্-পাকের কাছ থেকে পাওয়া-আমাদের উপর তা অর্পিত মাত্র। আমাদের সেই সম্পত্তি থেকে যে উদারভাবে দান করি কিংবা সেই দেহ-মন স্বাস্থ্য খাটিয়ে যে মানুষের সেবা করি, সে তো আমাদের নিজস্ব কোন কোরবানি নয়, কিংবা এমন কিছু তো নয়, যার জন্য আমরা পুরষ্কার দাবি করতে পারি।

দাউদ নবী এ সম্পর্কে বলেছেন যখন তিনি এবাদতগাহ্ নির্মাণের জন্য বহু অর্থ ব্যয় করন। তাঁর ভাষায়:

“কিন্তু আমি কে, আমার প্রজারাই বা কে যে, আমরা এই প্রকারে ইচ্ছাপূর্বক দান করিতে সক্ষম হই? সমস্তই তো তোমা হইতে আসে এবং তোমার হস্ত হইতে যাহা পাইয়াছি, তাহাই তোমাকে দিলাম।”

কিতাবুল মোকাদ্দস, ১ খান্দাননামা ২৯: ১৪

৩। আমরা যে আল্লাহ্-পাকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাঁর অবাধ্যতা করেছি, তাঁকে অপদস্ত করেছি, এমন কোন নেক কাজ নেই, যা দিয়ে সেই অপরাধ আমরা মোচন করতে পারি। তাঁর পবিত্রতা মহত্ব ও সত্যবাদীতা সীমাহীন। কিন্তু কেবল নেক কাজ আমাদের জন্য ক্ষমার ব্যবস্থা করে দিতে পারে না।

৪। আল্লাহ্‌র দরবারে হাজিরা দেবার জন্য আমাদের মধ্যে থাকতে হবে পবিত্রতা। সম্পূর্ণ পাক-সাফ না হলে কেউ কখনও আল্লাহ্কে দেখতে পারে না। কেবল সৎকর্মের দ্বারা আমরা পাক-সাফ হয়ে উঠতে পারি না। পবিত্রতা আরোপিত হয়েছে একমাত্র সেই ঈমানদারের উপর, যাঁর জন্ম আল্লাহ্‌র রূহ থেকে। ঈসা-কালেমাতুল্লাহ্ তাই বলেছেন:

“…পানি এবং পাক-রূহ হইতে জন্ম না হইলে কেহই খোদার রাজ্যে ঢুকিতে পারে না। মানুষ হইতে যাহা জন্মে, তাহা মানুষ, আর যাহা পাক-রূহ হইতে জন্মে, তাহা রূহ।”

ইঞ্জিল শরীফ, ইউহোন্না ৩: ৫-৬

এবাদত ও ক্ষমা

সন্দেহ নেই যে, আল্লাহ্-পাকের সঙ্গে কথা বলা আর তাঁর সত্তাকে নিয়ে ধ্যানের আকারে যে এবাদত, সেই এবাদতের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপিত হয়। কিন্তু পাপের জন্য পাপী যেহেতু আল্লাহ্‌র কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন, তাই তার এবাদত কবুল হতে পারে না। সে আল্লাহ্‌র কাছ থেকে কোন সাড়া পাবে না। ইশায়া-নবীর মাধ্যমে আল্লাহ্-পাক অন্ততঃ তাহাই এরশাদ করেছেন:

“তোমাদের অপরাধ তোমাদের ও তোমাদের আল্লাহ্‌র মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটাইয়াছে; তোমাদের পাপ তাঁহার মুখচ্ছবিকে ঢাকিয়া রাখিয়াছে, তাই তিনি তোমাদের কথা শুনেন না। বস্তুতঃ, তোমাদের করতল রক্তে ও তোমাদের অঙ্গুলি অপরাধে অপবিত্র হইয়াছে; তোমাদের ওষ্ঠ মিথ্যা কথা বলিয়াছে, তোমাদের জিহ্বা শয়তানীপূর্ণ কথা উচ্চারণ করে।”

কিতাবুল মোকাদ্দস, ইশাইয়া ৫৯: ২-৩

দাউদ-নবীও এই সত্য উপলব্ধি করেছিলেন। সত্য নবীর মাধ্যমে রূহের উক্তি:

“আমি যদি নিজ অন্তঃকরণে অপরাধ পোষণ করিতাম, তবে আল্লাহ্-পাক আমার কথা শুনিতেন না।”

জবুর শরীফ ৬৬: ১৮

রোযা ও ক্ষমা

রোযা রাখাও এবাদতের একটা অংশ। রোযা রাখার অর্থ আল্লাহ্-পাকের হুজুরে মানুষের হেয়তা ও অসহায়তা প্রকাশ করা। কিন্তু পাপের কারণে অধঃপতিত হবার আগে সে যে পবিত্র দশায় ছিল, কেবল রোযা রাখবার কারণে সেই দশায় ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। অন্যান্য এবাদতের মতো রোযাও আল্লাহ্‌র পবিত্রতার কাছে পাপের অপরাধ মুছে ফেলবার মতো কোন ক্ষতিপূরণ নয়। সুতরাং তা কখনও ক্ষমার উপায় বলে বিবেচিত হতে পারে না। জাকারিয়া-নবীর মাধ্যমে আল্লাহ্-পাক বলেছেন:

“….. যখন তুমি রোযা রাখিয়াছ ও কান্নাকাটি করিয়াছ, তখন তাহা কি আমার, আমার উদ্দেশ্যে করিয়াছ? আর যখন ভোজন কর ও পান কর, তখন কি নিজেরই জন্য ভোজন ও নিজেরই জন্য পান কর না?”

জাকারিয়া ৭: ৫-৬

উসংহার

  1. ১। মানুষের নাজাত কাফফারার ভিত্তিতে সম্ভব। এ কেবল দার্শনিক কোন তত্ত্ব নয়, বরং এমন প্রকৃত ঘটনা যে,অধঃপতিত মানুষের উপর থেকে পাপের বোঝা নামিয়ে ফেলবার জন্য এর অপরিহার্য প্রয়োজন রয়েছে।
  2. ২। আমরা সবাই স্বীকার করি যে, হযরত আদম পাপ করে পতিত হন এবং তাঁর এই পতন গোটা মানবজাতিকে জড়িয়ে ফেলে, কেননা আল্লাহ্‌র বিবেচনায় আদম ছিলেন মানুষের প্রতিনিধি। এই যুক্তিতে আল্লাহ্-পাক নিজের সুরতে সৃষ্ট মানুষকে মহব্বত বশতঃ পাপের শাস্তির হাত থেকে রক্ষার জন্য একটি বিকল্প বের করেন।

    এই বিকল্পকে অবশ্যই আল্লাহ্-পাকের ক্ষমতা আর মহব্বতের প্রকাশ ঘটাতে সক্ষম হতে হবে যেন মানুষ নাজাত লাভ করতে পারে। আল্লাহ্-পাকের সেই মহব্বতের প্রকাশ অবশ্যই ঘটবে খোদা আল্লাহ্‌রই পক্ষ থেকে। সুতরাং মানবজাতির প্রতি সেই মহব্বতের নিদর্শনস্বরূপ। তিনি ইচ্ছা করলেন যে, ঈসা-রুহুল্লাহ্ রক্ত মাংসের মানুষ হয়ে মানুষের সঙ্গে যুক্ত হবেন এবং মানুষের এমন একটা খাঁটি বিকল্প হবেন, যে বিকল্পকে আমাদের একজন রসূল “দ্বিতীয় আদম” নামে অভিহিত করেছেন। এইভাবে প্রথম আদম মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেছেন পতনের মধ্য দিয়ে, আর দ্বিতীয় আদম ছিলেন কাফফারার মধ্য দিয়ে পাপ-মোচনের জন্য মানুষের বিকল্প।

  3. ৩। এই প্রতিনিধির জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়ে দুনিয়ার বুক থেকে পাপ মুছে ফেলবার উদ্দেশ্যে পূর্ণ মূল্য-পরিশোধের। সলিবের উপর অকাতরে মৃত্যুবরণ করে ঈসা-রূহুল্লাহ্ সেই মূল্য পরিশোধ করেন এবং আমাদের সমস্ত পাপ তিনি নিজের দেহে নিয়ে নেন। এই ভাবে পুরনো কোরবানির রক্তের নযরানা থেকে সলিবের উপর এই নতুন কোরবানির চাহিদা সম্পর্কে আমরা বিশ্বাসী হয়ে উঠি, এবং এরই জন্য ঈসা-রূহুল্লাহ্কে বলা হয় “আল্লাহ্ মেষ”।
  4. তাঁর কোরবানির অনেক বৈশিষ্ট্যের এক বৈশিষ্ট হচ্ছে, এই কোরবানি কেবল যে, মানুষের পাপ মুছে ফেলে, তাই নয়-বরং মানুষের নৈতিক ব্যাধিও নিরাময় করে তোলে। সলিববিদ্ধ ঈসা-কালেমাতুল্লাহ্কে যে ব্যক্তিই গ্রহণ করে, তারই জীবন তাজা হয়ে উঠে। তার মনের মধ্যে পাপের প্রতি ঘৃণা জন্মায়। সলিব তার জ্ঞান চক্ষুকে এমনভাবে খুরে দেয় যে, পাপের ভয়াবহ চেহারা আর তার ভয়ঙ্কর শাস্তি সে স্পষ্ট দেখতে পায়।

    ঠিক এই পর্যায়ে হযরত ইউহোন্নার বাণী আমরা শুনতে পাই:

    “খোদা যেমন নূরে আছেন, আমরা যদি তেমনি নূরে চলি, তবে আমাদের মধ্যে যোগাযোগ-সম্বদ্ধ থাকে এবং তাঁহার পুত্র ঈসার রক্ত সমস্ত পাপ হইতে আমাদের পাক-পবিত্র করে।”

    ১ ইউহোন্না ১: ৭

    আল্লাহ্ পাক

    যে আমাদের মহব্বত করেন

    তাহার প্রমাণ এই যে

    আমরা পাপী থাকিতেই

    ঈসা-কালেমাতুল্লাহ্

    আমাদের জন্য প্রাণ দিয়াছিলেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।